মাসুম খান
সম্মানের মোহেই ছোট বেলা থেকে শিক্ষক হওয়ার লক্ষ্য স্থির করেছিলাম। ছাত্র জীবনে ৫ম ও ৮ম শ্রেনিতে বৃত্তি পেয়েছি, এস,এস,সি তে ৭৯৮ নম্বর পেয়ে কলেজ ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ন হয়ে ঢাকা সরকারি বিজ্ঞান কলেজে পড়াশুনা করেছি।ইংরেজি অনার্স করে মাস্টার্স চলাকালীন নিয়োগ পরীক্ষা দিয়ে শিক্ষকতায় প্রবেশ করি।
আমাদের সময় ৮৪ জন পরীক্ষা দিয়েছিল। আমরা ছয় জন লিখিত পরীক্ষার উত্তীর্ন হয়েছিলাম।লিখিত পরীক্ষা আমার মন মতো হয় নি। আমি ভেবেছিলাম আমি লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ন হবো না। কিন্তু আমাকে যে আরেক প্রার্থী নিয়ে গিয়েছিল উনি বলে, ভাই রেজাল্ট দেখে যান কি হয়। পরে তার নানা বাড়িতে দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে তিন টায় রেজাল্ট দেখতে এসে দেখি আমিও উত্তীর্নদের মধ্যে আছি।আমি কিছুটা অবাক হই।যা হউক ভাইভা পরীক্ষা অনেক ভাল হয়।তখন কারেন্ট ছাত্র।গ্রামার,লিটারেচার যা জিজ্ঞেস করেছি সবই পেরেছি।সবচেয়ে যে বিষয়টি সবাইকে ইম্প্রেস করেছে তাহলো আমার ইংরেজি বলার সাবলীলতা।তখন আমি সবে মাত্র IELTS করেছিলাম।ইংরেজি বলার ভাবে ছিলাম। আমাকে ভাইভা বোর্ডে জিজ্ঞেস করেছিল আপনি তো স্কুলে থাকবেন না,কলেজে সুযোগ পেলে চলে যাবেন।
আমি উত্তরে বলেছিলাম,আমার জীবনের লক্ষ্য শিক্ষক হওয়া এই কারনে যে আমি যাতে শিক্ষার্থীদের গড়ে তুলতে পারি,তাদের যাতে মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারি। কিন্তু কলেজে আমি ছাত্রদের মাত্র দুই বছর পাব। সেক্ষেত্রে তাদেরকে আমি মোটিভেট করার সময় খুব কম পাব।কিন্তু স্কুলে শিক্ষক হলে তাদের দীর্ঘ দিন পাব,ছোট বেলা থেকে পাব তাই তাদেরকে গড়ে তোলার অনেক সময় পাব। তাই আমি স্কুলেই শিক্ষকতা করতে চাই। পুরু উত্তর দিয়েছিলাম ইংরেজিতে। বোর্ডে থাকা সবাই না বুঝলেও যারা বুঝেছিল তারা রীতিমত ইমপ্রেস হয়েছিল উত্তরে।
পরে জয়েন করে শুনেছিলাম এলাকায় একটা রব উঠেগিয়েছিল যে একজন শিক্ষক এসেছে অনর্গল ইংরেজি বলে।সেই যে শিক্ষকতা তার মায়াজাল থেকে আর বের হতে পারলাম না। আমি ব্যাচ পড়াতাম না। থাকতাম শহরে শিক্ষকতা করতাম গ্রামে। নদী পাড় হয়ে যেতে হতো। সে এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা।
শুন্যপদে নিয়োগ ছয় মাস পরেই এম,পি,ও হয়ে যায়। কিছুদিন পরে সহকারি খাদ্য পরিদর্শক পদে পরীক্ষা দিয়ে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ন হয়ে ভাইভা পরীক্ষা দেই। সেখানে ভাইভা বোর্ড বলে আপনি তো শিক্ষকতা করেন,ভাল স্কেল,সম্মানের চাকুরি। আমি নিজে নিজে খুব গর্বিত হই। এছাড়া আর কোন সরকারি চাকুরির জন্য পরীক্ষা দেই নি। বিসিএস একবার দিয়েছিলাম। প্রিলিতে টিকেছিলাম কিন্তু অনার্সের রেজাল্ট ভাল না থাকাতে লিখিত পরীক্ষা দেয়ার উৎসাহ হয় নি।কিন্তু পরে বুঝেছি এটা ঠিক হয় নি।
নিজেকে শিক্ষক ভাবতে খুব গর্ব হতো, ভাল লাগতো। কিন্তু সময়ের আবর্তে অনুধাবন করতে শুরু করি শিক্ষকদেরকে সমাজে কেমন জানি অন্য চোখে দেখে,সামাজিক ভাবে সবাই খুব মর্যাদাশীল ভাবে না।বেশ কয়েকজন মুরুব্বী শিক্ষকতা করি শুনে কষ্ট পায়।আমি বুঝি না কি ব্যাপার।আমি একদিন এক মুরুব্বীকে বলি ভাল ছাত্রই তো শিক্ষক হবে। শিক্ষক যদি ভাল ছাত্র না হয় তাহলেতো ভালভাবে পড়াশুনা করাতে পারবে না।আর শিক্ষক ভাল ভাবে না পড়ালেতো কেউ ভাল কিছুই হতে পারবে না।
আসলে আমাদের এস,এস,সি ব্যাচের ফাস্ট বয় ডাক্তার, আমি ছিলাম সেকেন্ড বয়,থার্ড বয় হাইকোর্টের আইনজীবী, ফোর্থ বয় অস্ট্রেলিয়ার পড়াশুনা করে সেখানে সেটেল্ড, ৫ম জন ইঞ্জিনিয়ার,৬ রোল ধারী জাপানে পড়াশুনা করে সেখানেই সেটেল্ড, ৭ এবং ১১ রোল ধারী চ্যাটার একাউন্টেন্ট, আরেক ব্যাচ মেট আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু নেদারল্যান্ড সেটেল্ড।। এছাড়াও ২০ পর্যন্ত যাদের রোল ছিল সবাই সুপ্রতিষ্ঠিত।অনেক পিছনের রোল ধারী সহপাঠিরা ও প্রতিষ্ঠিত। তাই হয়ত এলাকায় যারা ছোট বেলা থেকে চিনে তারা আমার স্কুল শিক্ষক হওয়াকে অন্যভাবে দেখে।
যা হউক আমি শিক্ষকতা করে আনন্দ পেতাম। দুই একটা হোম টিউশনি করাতাম নারায়নগঞ্জ শহরে। কিন্তু আব্বার চাকুরি থেকে অবসরের পর বড় ছেলে হিসেবে সংসারের দায়িত্ব এসে যায়। কিন্তু তখনো ব্যাচ পড়াতাম না। টিউশনি কয়েকটা বাড়িয়ে করতাম। আমি স্কুলে ক্লাসে পড়ানোর পর কেউ না বুঝলে তাদেরকে ক্লাসের আগে আসতে বলতাম। আগ্রহী কেউ কেউ আসত। আমি তাদের জন্য সময় দিতাম মাঝে মাঝে।অথচ আমার সহকর্মিরা স্কুলের আগে ৩ ব্যাচ পরে এক ব্যাচ পড়াতো।আবার রাতে হোম টিউশনিতো করতই। আমি অবাক হতাম। সকালে স্কুলের আগে তিনটা ব্যাচ পড়িয়ে স্কুলে ৫-৭ টা ক্লাস যথাযথ ভাবে করা কি করে সম্ভব? শত প্রয়োজন অভাব আমাকে নীতি ও আদর্শ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। সহকর্মিরা আমাকে ব্যাচ পড়াতে বলতো। ছাত্রারাও পড়তে চাইত। কিন্তু আমি দেখেছি ব্যাচ পড়ানো নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে অপকৌশল, রাজনীতি যত অনৈতিকতা।এসব আমার কাছে মোটেই ভাল লাগত না।
আমি যেসব শিক্ষার্থীদের স্কুলের আগে মাঝে মাঝে পড়াতাম তাদের মধ্যে আমার শিক্ষকতা জীবনের প্রথম ব্যাচের দুজন শিক্ষার্থী ডাক্তার হয়েছে। আজ আমার অনেক ছাত্র ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার এবং বিদেশে পড়াশুনা করে, সুপ্রতিষ্ঠিত। ভাবতে কতই না আনন্দের!কিছুদিন আগে আমার এক ছাত্রের সাথে দেখা হয়।ছাত্রটি বাজারে সকলের সামনে আমার পা ছুয়ে সালাম করে।আমি কিছুটা হতচকিত হয়ে যাই,ইতস্তত হই,পূলকিত হই,গর্বিত হই।সবাই আমার দিকে তাকিয়ে ছিল।
আমি দ্রুত শিক্ষার্থীর হাতটি পা থেকে সরিয়ে বলি, বোকা ছেলে, বড় হয়েছে না, এখন এভাবে সালাম করতে হয় না। কিন্তু আমার চোখের সামনে যেন ভাসতেছিল আমার সেই শ্রদ্ধেও অনন্য ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন শিক্ষকের কথা যাকে দেখে আমি ছোট বেলায় শিক্ষক হওয়ার জন্য অনুপ্রানিত হয়েছিলাম, পন করেছিলাম। চোখ ছল ছল করছিল।মনে হচ্ছিল,না আমি শিক্ষক হয়ে ভুল করি নাই। বার বার স্যারকে দেখতে ইচ্ছা করছিল।আর বলতে ইচ্ছা করছিল, স্যার সত্যি শিক্ষকতা শুধু পেশা নয়।
Discussion about this post