প্রজ্ঞা দাস
একটি জাতির চিন্তার ক্ষেত্র হলো তার শিক্ষাব্যবস্থা। শিক্ষা শুধু পুথিগত বিদ্যার আয়না নয়, এটি মনন, নৈতিকতা, আত্মদর্শন এবং সৃজনশীলতার গভীর জগতে প্রবেশের পথ। কিন্তু বর্তমান যুগ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার। যখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিশ্বের প্রতিটি কোণে তার অপ্রতিরোধ্য উপস্থিতি জানান দিচ্ছে, তখন শিক্ষাব্যবস্থাও এর প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। এআই শিক্ষায় এমন এক বিপ্লব নিয়ে এসেছে, যা শিক্ষার্থীদের জন্য অভূতপূর্ব সম্ভাবনার জানালা খুলে দিয়েছে, কিন্তু একই সঙ্গে এটি শিক্ষার মৌলিকতা ও সৃজনশীলতার ওপর এক অশনি ছায়া ফেলছে। মূলত ছাত্রের মনে প্রশ্ন জাগা, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক, ভুল থেকে শেখা, ধৈর্য, পরিশ্রম এসব কিছু মিলেই গঠিত হয় শিক্ষার প্রাণ। কিন্তু এআই শিক্ষার প্রথাগত কাঠামোকে পুনর্নির্মাণ করছে।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২৪ সালে শিক্ষায় এআইর বৈশ্বিক বাজার ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে এবং ২০২৫ সালে এটি ৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০৩০ সালের মধ্যে এ বাজার ২০ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করবে, যা বেশ আশঙ্কাজনক। এআইর ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা শিক্ষার্থীদের শিক্ষক থেকে দূরে নিয়ে যাচ্ছে। ক্লাসরুমে শিক্ষক এক জীবন্ত অনুপ্রেরণা, যিনি শুধু পাঠ্যবই পড়ান না, বরং ছাত্রের জীবনের প্রতিটি বাঁকে চিন্তার দিকনির্দেশনা দিন। আজ সেই শিক্ষককেও প্রযুক্তির কাছে হার মানতে হচ্ছে। যান্ত্রিক সফটওয়্যার বা অ্যাপ আজ ‘ভবিষ্যতের শিক্ষক’ নামে প্রচার পাচ্ছে, যেখানে ছাত্রছাত্রী শুধু স্ক্রিনে চোখ রেখে একতরফা তথ্য গ্রহণ করছে। এতে করে হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের সঙ্গে মানুষের সংবেদনশীল সংযোগ, যে সংযোগের মাধ্যমে একজন শিক্ষক একজন শিশুকে মানুষ করে তোলেন। পাশাপাশি এআই শিক্ষার্থীদের সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনার ক্ষমতাকেও দুর্বল করে দিচ্ছে। যখন শিক্ষার্থীরা এআইর মাধ্যমে তাৎক্ষণিক সমাধান পায়, তখন তারা নিজেদের বিশ্লেষণ ক্ষমতা এবং সমস্যা সমাধানের দক্ষতা বিকাশের সুযোগ হারায়। শুধু তাই নয়, এআইর অত্যধিক ব্যবহার শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতাকেও সীমিত করছে। এটি শিক্ষার্থীদের গভীর শিক্ষণ প্রক্রিয়াকেও বাধাগ্রস্ত করছে, যা তাদের মানসিক বিকাশের জন্য অপরিহার্য ছিল। ২০২৪ সালে ইউনেসকোর একটি সমীক্ষায় বলা হয়েছে, বিশ্বজুড়ে এআইর অত্যধিক ব্যবহারের ফলে ৩৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর সৃজনশীল লেখার ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে, যা শিক্ষার মৌলিকতার জন্য উদ্বেগজনক। এভাবে ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছে এমন এক প্রজন্ম, যারা তথ্য জানে, কিন্তু বোঝে না। যারা প্রবন্ধ লিখতে পারে, কিন্তু অনুভব করতে পারে না। যারা থিসিস জমা দিতে পারে, কিন্তু কোনো গবেষণার গভীরে যেতে চায় না। শিক্ষা শুধু দক্ষতা নয়; এর গভীরে রয়েছে মানবিকতা, নৈতিকতা ও বিবেকের এক গভীর অনুশীলন। কিন্তু এআই একটি যান্ত্রিক লজিকে ভিত্তি করে তৈরি, যার নেই নৈতিক বোধ, নেই বিবেক, নেই সহানুভূতি। এ প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীলতা শিক্ষার্থীদের এমন এক মূল্যবোধ শূন্যতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে, যেখানে সবকিছুই হয়ে উঠছে ফলনির্ভর, দ্রুততর, কিন্তু অন্তঃসারহীন। একজন শিক্ষার্থী যখন নিজের দায়িত্ববোধ ভুলে শুধু ফলাফলের জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ওপর ভরসা করে, তখন তার মধ্যে বিবেকবোধ, সততা, শ্রমের মূল্যবোধ সবকিছুই অবচেতনে লোপ পায়। প্রযুক্তির অন্ধ অনুকরণে শিক্ষার্থীরা ভুলে যাচ্ছে কেন শেখা জরুরি; তারা শুধু কীভাবে পাস করা যায় সেই প্রযুক্তি খুঁজতে ব্যস্ত। বাংলাদেশেও দ্রুতগতিতে এআই নির্ভরতা বাড়ছে। বর্তমান শিক্ষা যদি এআইর হাতে ন্যস্ত হয়, তাহলে ভবিষ্যতের সমাজ হবে এমন এক যান্ত্রিক সভ্যতা, যেখানে থাকবে তথ্যের পাহাড়, কিন্তু সর্বত্র বিরাজমান উপলব্ধির শূন্যতা। থাকবে ডিগ্রিধারী লক্ষ-কোটি মানুষ, কিন্তু চিন্তাশীল নাগরিকের অভাব। শিক্ষায় এআইর ভূমিকা ক্রমেই বাড়ছে এবং এটি থামানো সম্ভব নয়। তবে শিক্ষার মৌলিকতা রক্ষা করতে হলে এআইর ব্যবহারে সচেতনতা এবং নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। শিক্ষাব্যবস্থাকে এমনভাবে পুনর্গঠন করতে হবে, যাতে এআই শিক্ষার্থীদের সহায়ক হয়, কিন্তু তাদের সৃজনশীলতা এবং সমালোচনামূলক চিন্তার ক্ষেত্রে বাধা না হয়ে দাঁড়ায়। শিক্ষক, নীতিনির্ধারক ও প্রযুক্তি উন্নয়নকারীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় শিক্ষার মৌলিকতা এবং এআইর সুবিধার মধ্যে ভারসাম্য স্থাপন করতে হবে। এ ভারসাম্য নিশ্চিত করা গেলে, এআই শিক্ষাব্যবস্থাকে আরও সমৃদ্ধ এবং গতিশীল করতে পারে। যেখানে শিক্ষার্থীরা তাদের সৃজনশীলতা ও মৌলিকতা বজায় রেখে প্রযুক্তির সুবিধা উপভোগ করতে পারবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কোনোভাবেই শিক্ষার শত্রু নয়, যদি তা ব্যবহৃত হয় সহায়ক শক্তি হিসেবে। কিন্তু আজকের দুনিয়ায় এআই সহায়ক নয়, বরং প্রাধান্য বিস্তারকারী এক স্বৈরাচারী প্রযুক্তি হয়ে উঠছে। এ গ্রাস থামাতে না পারলে আগামী প্রজন্ম আর মানুষ হবে না, তারা হবে সফটওয়্যারের ইনপুট ডিভাইস মাত্র। যারা একদিন হয়তো ডিগ্রি নিয়ে গর্ব করবে, কিন্তু তাদের হৃদয় থাকবে ফাঁকা আর অন্তঃসারশূন্য। আর অন্তঃসারশূন্য জাতি কখনো উন্নতি লাভ করতে পারে না।
লেখক- প্রজ্ঞা দাস, শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ,ইডেন মহিলা কলেজ।
Discussion about this post