শিক্ষার আলো ডেস্ক
১৮তম শিক্ষক নিবন্ধন মৌখিক পরীক্ষায় ৮৩ হাজার পরীক্ষার্থী অংশ নিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে ২৩ হাজার উত্তীর্ণ হতে পারেননি। এখন উত্তীর্ণ না হওয়া পরীক্ষার্থীদের দাবি, তাদের ইচ্ছাকৃতভাবে অকৃতকার্য করানো হয়েছে। তাদের উত্তীর্ণের সনদ দিতে হবে।
প্রার্থীরা বলেন, যেহেতু এনটিআরসিএ লিখিত পরীক্ষায় নিজেদের করা ‘প্রশ্নের ধারা ও মানবণ্টন’ বহির্ভূত বিকল্প প্রশ্নবিহীন প্রশ্নপত্রে আমাদের পরীক্ষা নিয়েছে এবং সে লিখিত পরীক্ষায় আমরা পাস করে এসেছি এবং আমাদের বেশিরভাগেরই ভাইভার সনদপত্রে ১২ নম্বর রয়েছে তাই মানবিক বিবেচনায় হলেও পাস করানো হোক।
তাদের দাবিগুলো হচ্ছে যেহেতু
এনটিআরসিএর বিধিমালায় ভাইভার মোট নম্বরের ৪০ শতাংশ পেলেই পাসের কথা বলা হয়েছে। তাই যাদের সনদপত্র ও প্রশ্নোত্তরের নম্বর মিলে ৪০ শতাংশ বা তার বেশি আছে তাদের সবাইকে পাস করিয়ে নিয়োগ কার্যক্রমে অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে হবে।
আবার,১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনে উত্তীর্ণ হলেও সুপারিশবঞ্চিত প্রার্থীরা চূড়ান্ত নিয়োগ ও বিশেষ গণবিজ্ঞপ্তির দাবিতে বিক্ষোভ করছেন। বিক্ষোভকারীদের অভিযোগ, সারা দেশে এক লাখেরও বেশি শূন্য পদের বিপরীতে এখন পর্যন্ত ৪১ হাজার ৬২৭ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করা হলেও ৬০ হাজারেরও বেশি পদ খালি রয়েছে। অথচ ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রায় ১৬ হাজার ২১৩ জন প্রার্থী সুপারিশ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
তাঁদের দাবি, আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সব শূন্য পদ যুক্ত করে দ্রুত সময়ের মধ্যে বিশেষ গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে হবে। দাবি আদায় না হলে আরও কঠোর কর্মসূচির ঘোষণা দেন সুপারিশবঞ্চিত প্রার্থীরা।
আবারও ১৮তম নিবন্ধনধারীদের একটি অংশ বয়সজনিত জটিলতায় গণবিজ্ঞপ্তিতে আবেদনের সুযোগ পায়নি! জানা যায়, ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধন সার্কুলার প্রকাশিত হয় ২০২৩ সালের ২ নভেম্বর। দীর্ঘ দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে পরীক্ষার প্রতিটি ধাপ শেষে চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশিত হয় ২০২৫ সালের ৪ জুন। এতে অনেকের বয়স শেষ হয়ে যায়। অথচ সবার সনদের মেয়াদ এখনও বিদ্যমান। এই অজুহাতে ১৮তম নিবন্ধনধারীরা একবারও গণবিজ্ঞপ্তিতে আবেদনের সুযোগ পায়নি।
গত জুন মাস থেকে নানা কর্মসূচীর মাধ্যমে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন বিভিন্নভাবে বঞ্চিত হাজারো নিয়োগপ্রার্থী । সর্বোচ্চ মেধা ও যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েও নিয়োগ না পাওয়ায় এই বিশাল সংখ্যক প্রার্থী এখন প্রচণ্ড হতাশা, মানসিক চাপসহ পারিবারিক ও সামাজিক নিগ্রহের শিকার।’
অন্যদিকে বঞ্চিতদের পক্ষে রীটকারীদের আদেনের প্রেক্ষিতে ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের মৌখিক পরীক্ষায় (ভাইভা) অংশ নেওয়া সবাইকে শিক্ষক নিবন্ধনের সনদ দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন হাইকোর্ট। গত বৃহস্পতিবার (৩ জুলাই) আদালতের রায়ের কপি হাতে পায় বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) কর্মকর্তারা। এনটিআরসিএ এর বিরুদ্ধে আপিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

১৮ তম নিবন্ধন সনদ বঞ্চিত মো. আব্দুর রশীদ তুলে ধরেন এই বৈষম্যের চিত্র।
বাংলাদেশে শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা শুরু হওয়ার পর থেকে ধাপে ধাপে তিনটি স্তরে পরীক্ষা নেওয়া হয়— প্রিলিমিনারি, লিখিত ও ভাইভা। এর মধ্য দিয়ে একজন প্রার্থী চূড়ান্তভাবে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়ে শিক্ষক হওয়ার সুযোগ পান।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনগুলোর চিত্র



১৩তম নিবন্ধন
প্রিলিতে অংশ নেয় প্রায় ৫.৭৫ লাখ প্রার্থী। লিখিত অংশগ্রহণ করে ১.৪৭ লাখ, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভাইভায় মাত্র ১৭,২৫৪ জন উত্তীর্ণ হয়। পরে মামলার মাধ্যমে আরও ২,২০৭ জন নিয়োগ পান।

১৪তম নিবন্ধন
লিখিত অংশগ্রহণ: ১,৬৬,৩১৮ জন
ভাইভায় অংশগ্রহণ: ১৯,৮৬৩ জন
চূড়ান্ত উত্তীর্ণ: ১৯,১৬৩ জন (পাশের হার ৯৬.৪৭%)

১৫তম নিবন্ধন
লিখিত অংশগ্রহণ: ১,২১,৬৬০ জন
লিখিত উত্তীর্ণ: ১৩,৩৪৫ জন
ভাইভায় উত্তীর্ণ: ১১,১৩০ জন (পাশের হার ৮৩.৪০%)

১৬তম নিবন্ধন
লিখিত অংশগ্রহণ: ১,৫৪,৬৬৫ জন
লিখিত উত্তীর্ণ: ২২,৩৯৮ জন
ভাইভায় উত্তীর্ণ: ১৮,৫৫০ জন (পাশের হার ৯২.১৫%)

১৭তম নিবন্ধন
ভাইভার জন্য মনোনীত: ২৬,২৪২ জন
ভাইভায় অংশগ্রহণ: ২৫,২৪০ জন
চূড়ান্ত উত্তীর্ণ: ২৩,৯৮৫ জন (পাশের হার ৯৫.০২%)


এখানে স্পষ্ট দেখা যায় যে, ১৪তম থেকে ১৭তম নিবন্ধনে ভাইভা উত্তীর্ণদের প্রায় সবাই সনদ পেয়েছেন।
প্রিলি অংশগ্রহণ: ১৩,৪০,৮৩৩ জন
লিখিত অংশগ্রহণ: ৪,৭৯,৯৮১ জন
ভাইভার জন্য মনোনীত: ৮৩,৮৬৫ জন
ভাইভায় অংশগ্রহণ: ৮১,২০৯ জন
চূড়ান্ত উত্তীর্ণ: মাত্র ৬০,৬৩৪ জন (পাশের হার ৭০%)
অর্থাৎ, ১৮তম নিবন্ধনে হঠাৎ করে ৩০% প্রার্থীকে বাদ দেওয়া হয়েছে, যেখানে পূর্ববর্তী নিবন্ধনে ৮৫-৯৬% প্রার্থী উত্তীর্ণ হতেন। এভাবে হাজার হাজার যোগ্য প্রার্থী বৈষম্যের শিকার হয়েছেন।
কেন ১৮তম নিবন্ধনধারীরা সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত?

পূর্বের ধারা ভঙ্গ: আগের নিবন্ধনগুলোতে প্রায় সবার হাতে সনদ তুলে দেওয়া হলেও ১৮তম নিবন্ধনে হঠাৎ ভিন্ন নিয়মে উত্তীর্ণ সংখ্যা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।

ভবিষ্যৎ সুযোগ নেই: সরকারের নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরবর্তী নিবন্ধন পরীক্ষার ধরন ও সুপারিশ পদ্ধতি পরিবর্তন হতে যাচ্ছে। ফলে ১৮তমদের আর নতুন করে সুপারিশ পাওয়ার কোনো সুযোগ থাকবে না।

শূন্যপদ থাকা সত্ত্বেও বঞ্চনা: ১৮তম নিবন্ধনের সময়ও দেশে এক লাখের বেশি শিক্ষক শূন্যপদ ছিল। তবুও যোগ্য প্রার্থীদের বাদ দেওয়া হয়েছে।

সমান সুযোগ নষ্ট: একই জাতীয় পরীক্ষায় অংশ নিয়েও ১৮তমরা তাদের পূর্বসূরিদের মতো সমান সুযোগ পাননি।

১৮তম নিবন্ধনধারীরা যেনো চূড়ান্তভাবে সুপারিশ পান—এটাই ন্যায্য দাবি।
অন্য নিবন্ধনে ভাইভায় উত্তীর্ণ প্রায় সবাই সুপারিশ পেয়েছেন।
১৮তমরা যোগ্য হয়েও শুধু শতাংশের খেলায় বঞ্চিত হয়েছেন।
আবার ভাইভায় উত্তীর্ণ হয়েও সুপারিশ পাননি অনেকে!
পরবর্তীতে আর কোনো সুপারিশের সুযোগ না থাকায় তারা আজীবন ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
পরিশেষে বলা যায় যে, ১৮তম নিবন্ধনধারীদের বঞ্চিত রেখে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়া এক চরম বৈষম্য।
বাংলার শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্যের কোনো স্থান নেই। তাই যারা ভাইভায় অংশ নিয়েও সনদ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, তাদের অবিলম্বে সুপারিশ প্রদান করতে হবে।
তা না হলে হাজার হাজার মেধাবী ও পরিশ্রমী তরুণ শিক্ষকের ভবিষ্যৎ ধ্বংস হয়ে যাবে এবং এনটিআরসির ওপর দেশের শিক্ষার্থীরা আস্থা হারাবে।
Discussion about this post