মেহেদী হাসান
একই পাঠ্যক্রম, একই ক্লাসঘণ্টা ও সমপরিমাণ দায়িত্ব পালন করলেও ৫৪ বছর ধরে পাহাড়সম আর্থিক বৈষম্যের শিকার দেশের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৫ লক্ষাধিক শিক্ষক। এ দেশে শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রায় ৯৭ ভাগ অবদান রেখে চলা এসব শিক্ষকদের যাপিত জীবনের বিরাট অংশ জুড়ে লেগে আছে আর্থিক অনটন আর বিভিন্ন ক্ষেত্রে বঞ্চনা। এদিকে দেশে প্রচলিত কাঠামোয় সরকারি শিক্ষকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বৈষম্যের শিকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। প্রাথমিকেই শিশুর শিক্ষার ভিত তৈরি হয়, কিন্তু যারা সেই ভিত রচনা করেন সেই শিক্ষকরা এখনো তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী! প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের বেতনের পরিমাণের দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সর্বনিম্ন। এসব কারণে ক্লাসরুম ছেড়ে শিক্ষকদের নামতে হচ্ছে রাজপথে। শিক্ষকদের এই বঞ্চনায় তলানিতে যাচ্ছে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা। সংশ্লিষ্টরা বলেন, শিক্ষকদের মান-মর্যাদা না বাড়িয়ে জাতির উন্নয়ন সম্ভব নয়।
এদিকে বেতন-ভাতা, মর্যাদা, পদোন্নতি, অবসর সুবিধা—সবক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকদের মধ্যে বিশাল ফারাক বিদ্যমান থাকা অবস্থায় আজ রবিবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব শিক্ষক দিবস। ১৯৯৫ সাল থেকে প্রতি বছর ৫ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালন করা হয়। ইউনেসকোর মতে, বিশ্ব শিক্ষক দিবস শিক্ষা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ পালন করা হয়ে থাকে। বর্তমানে বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১০০টি দেশে এই দিবসটি পালিত হয়। এই দিবসটি পালনে এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল ও তার সহযোগী ৪০১টি সদস্য সংগঠন মূল ভূমিকা রাখে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘শিক্ষকতা পেশা:মিলিত প্রচেষ্টার দীপ্তি’।
শিক্ষকতা শুধু একটি পেশা নয়; বরং এটি একটি জীবনব্রতের নামও। আমাদের সমাজে বহুল ব্যবহৃত একটি কথা হলো, মা-বাবা সন্তানকে জন্ম দিলেও তাদের মানুষ হিসেবে গড়ার কারিগর শিক্ষকেরাই। তাদের হাতে গড়ে ওঠে মূল্যবোধ, নৈতিকতা আর জীবনের সঠিক পথচলার মানচিত্র। শিক্ষার্থীদের সুপ্ত প্রতিভা, ব্যক্তিত্বের জাগরণ, মেধার উৎকর্ষ সাধন করে তাদের জীবন আলোকিত করে তোলেন একজন আদর্শ শিক্ষক। একজন শিক্ষকের ছাত্রছাত্রীরাই রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়োজিত থাকেন। প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ-মাধ্যমিক কিংবা উচ্চশিক্ষা সব কাঠামোতেই শিখন-পাঠনসহ সব কাজই করতে হয় শিক্ষকদের। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই বাজারে নামমাত্র বেতনে শিক্ষকদের টিকে থাকা যেন এক কঠিন সংগ্রাম।
শিক্ষবিদ, শিক্ষক নেতা ও শিক্ষা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৮২ সালের আগে বেসরকারি শিক্ষকদের সরকারি অর্থ বিভাগ থেকে বেতন-ভাতার সরকারি অংশ প্রদান করা হতো মাত্র ৫০ ভাগ। ১৯৮২ সালে এইচ এম এরশাদ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে তা ৮০ ভাগে উন্নীত করা হয়। সে সময় শিক্ষকদের বাড়িভাড়া ছিল ১০০ টাকা আর চিকিৎসা ভাতা ছিল ১৫০ টাকা। এমন অমানবিক ও অবিবেচনাপ্রসূত বাড়িভাড়া এবং চিকিৎসা ভাতার বিষয়ে শিক্ষকসমাজ বছরের পর বছর আন্দোলন করেও তা বাড়াতে পারেনি। এটি বাড়াতে না পারার পেছনে শিক্ষক নেতাদের দলাদলিও কম দায়ী নয়। পরবর্তী সময়ে ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এসে শিক্ষকদের জন্য কল্যাণ ট্রাস্টের ব্যবস্থা করে, যা ছিল বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এরপর ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে শিক্ষকদের বেতন-ভাতার সরকারি অংশ ৮০ ভাগ থেকে বাড়িয়ে ৯০ ভাগে উন্নীত করে। এটি বেশ প্রশংসনীয় হলেও শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের দাবি বাসাভাড়া এবং চিকিৎসা ভাতা আগের মতোই থেকে যায়। এরপর ২০০১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এলে শিক্ষকদের জন্য অবসর-সুবিধা ও ২০ ভাগ উৎসব ভাতার ব্যবস্থা করে এবং বেসরকারি শিক্ষকদের বেতন-ভাতার সরকারি অংশ ১০০ ভাগ করার ঘোষণা দেয়। কিন্তু তারা বেসরকারি শিক্ষকদের বেতন-ভাতার সরকারি অংশ ৯৫ ভাগ পর্যন্ত কার্যকর করতে পেরেছিল। কারণ, তখন ১-১১ সরকার দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসেছিল। পরবর্তী সময়ে ১-১১ সরকার বিএনপির প্রতিশ্রুত বেসরকারি শিক্ষকদের বেতন-ভাতার সরকারি অংশ বাকি ৫ ভাগ কার্যকর করেছিল। বেসরকারি শিক্ষকদের বেতন-ভাতার সরকারি অংশ ১০০ ভাগে উন্নীত হলেও বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতা সেই তিমিরেই রয়ে যায়। এর ফলে সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকদের মধ্যে বেতন-ভাতার একটি বড় ফারাক রয়ে যায়।
২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের দাবি বাড়িভাড়া ১০০ থেকে বাড়িয়ে ৫০০ টাকা এবং চিকিৎসা ভাতা ১৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০০০ টাকা করে। অন্যদিকে সরকারি-বেসরকারি সব কর্মচারী-কর্মকর্তার জন্য ২০ ভাগ হারে বৈশাখী ভাতার ব্যবস্থা করে। তাছাড়া দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে চাকরিজীবীদের জীবনযাপনে যাতে কোনো অসুবিধার সৃষ্টি না হয়, সে জন্য সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্য সময়ে সময়ে মহার্ঘ ভাতার ব্যবস্থা ছিল। আওয়ামী লীগ সরকার এটা তুলে দিয়ে প্রতি বছর চাকরিজীবীদের জন্য ৫ ভাগ হারে ইনক্রিমেন্টের ব্যবস্থা করে। বর্তমানে সেই বাসাভাড়া এবং চিকিৎসা ভাতা নিয়েই শিক্ষকেরা পথ চলছেন। অথচ ২০১৫ সালে আওয়ামী লীগ সরকার যে যুগান্তকরী পে স্কেলের ঘোষণা করেছিল, তাতে সরকারি-বেসরকারি সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেলেও শুধু বেসরকারি শিক্ষকদের বাসাভাড়া এবং চিকিৎসা ভাতা না বাড়ার কারণে তারা আর্থিকভাবে তেমন লাভবান হননি। একজন সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারী তার মূল বেতনের প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ ভাগ এবং জায়গা ও ক্ষেত্রবিশেষে ৪৫ থেকে ৫০ ভাগ পর্যন্ত বাড়িভাড়া পেয়ে থাকেন। এর ফলে তাদের বেতনের সঙ্গে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের বড় একটি বৈষম্য লেগেই আছে। তাছাড়া একজন সরকারি শিক্ষক বা কর্মচারী ১ হাজার ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা এবং দুজন পড়ুয়া সন্তানের জন্য মাসিক ১ হাজার ৫০০ টাকা করে শিক্ষা ভাতা পেয়ে থাকেন, যার প্রচলন বেসরকারি শিক্ষকদের ক্ষেত্রে নেই। এর বাইরে সরকারি শিক্ষকেরা বছরে দুবার উৎসব ভাতা পান মূল বেতনের সমপরিমাণ। বেসরকারি শিক্ষকেরা উৎসব ভাতা পান মূল বেতনের ২৫ ভাগ আর কর্মচারীরা পান ৫০ ভাগ। যে নিয়ম পৃথিবীর কোনো দেশে নেই। অন্যদিকে সরকারি কর্মচারীরা তাদের সমগ্র চাকরিজীবনে আর্থিকভাবে অনেক সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন। এর ফলে তাদের পরিবারে আর্থিক দৈন্য তেমন একটা থাকে না বললেই চলে।
অন্যদিকে বেসরকারি শিক্ষকেরা সরকারি নিয়ম অনুযায়ী তাদের বেতনের অনেক কিছু থেকেই বঞ্চিত হওয়ার কারণে তাদের পরিবারে আর্থিক দৈন্য লেগেই থাকে। আরও একটি বিষয় হচ্ছে, বেসরকারি শিক্ষকদের চাকরিজীবন শেষে তাদেরই জমাকৃত অর্থ থেকে যে অবসর-সুবিধার টাকা দেওয়া হয়, তা-ও অনেক সময় এসব শিক্ষকেরা জীবিত অবস্থায় পান না। এসব টাকা পেতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। এর ফলে চাকরি শেষে বেসরকারি শিক্ষকেরা আরও অসহায় হয়ে পড়েন। জীবনের স্বর্ণালী সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাটানো শিক্ষকদের অনেক সময় দেখা যায়, নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে অবসরের সময় কোনো আর্থিক সুবিধাও পান না।
চলমান কাঠামোগত অবস্থানের কারণে শিক্ষায় সবচেয়ে বেশি বৈষম্য বলে মনে করছেন দেশের শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা। দেশে বর্তমানে সবচেয়ে কম বেতন পাচ্ছেন শিক্ষার প্রাথমিক স্তরের শিক্ষকরা। প্রাথমিকের শিক্ষকরা তৃতীয় শ্রেণির এবং প্রধান শিক্ষকরা দ্বিতীয় শ্রেণির হিসেবে বিবেচিত হন রাষ্ট্রীয় কাঠামোয়। অথচ শিক্ষার এ স্তরে সবচেয়ে বেশি ঝামেলা পোহাতে হয় প্রাথমিকের শিক্ষকদের।
Discussion about this post