প্রফেসর ড. নারায়ন বৈদ্য
ইংল্যান্ডের বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ টমাস রবার্ট ম্যালথাস ১৭৬৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল ড্যানিয়েল ম্যালথাস। পিতা-পুত্র ইংল্যান্ডের ‘এলব্যারি হাউস’- নামক একটি বাড়িতে বসবাস করতেন। পিতা ড্যানিয়েল ম্যালথাস ছিলেন একজন ধর্মযাজক। ছোটবেলা থেকে পিতা, পুত্রের আচরণ ও ব্যবহারে এতই মুগ্ধ ছিলেন যে, তিনি মনে করতেন, তাঁর পুত্র রবার্ট বড় হয়ে একজন চিন্তাবিদ হবে। পিতার এ আশা বিফলে যায়নি। একারণে প্রায়ই পিতা ড্যানিয়েল ম্যালথাস পুত্র টমাস রবার্ট ম্যালথাসকে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর প্রশ্ন করতেন। পুত্র ঐ বিষয়সমূহের ওপর গভীর মনোযোগ দিয়ে আলোচনা করে, যুক্তি সহকারে এমনভাবে বুঝিয়ে দিতেন যে, এতে পিতা ড্যানিয়েল ম্যালথাস অভিভূত হয়ে যেতেন। একদিন সকালে চায়ের টেবিলে বসে পিতা ড্যানিয়েল ম্যালথাস পুত্রকে ইংল্যান্ডের ভবিষ্যৎ জনসংখ্যা সম্পর্কে প্রশ্ন করেন। পুত্র টমাস রবার্ট ম্যালথাস যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন যে, অদূর ভবিষ্যতে ইংল্যান্ডের দুর্যোগ অনিবার্য্য। কারণ জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না। অতএব ইংল্যান্ডে দুর্ভিক্ষ অবশ্যম্ভাবী। জনসংখ্যা ও খাদ্য উৎপাদনের এ ভারসাম্যহীনতার কারণে প্রকৃতি নিজেই প্রতিশোধ নিয়ে সমতা আনার চেষ্টা করে। এ প্রাকৃতিক প্রতিশোধের মধ্যে আছে যুদ্ধ, মহামারী, দুর্ভিক্ষ, বন্যা, ঝড়, ভূমিকম্প ইত্যাদি। শেষ পর্যন্ত সেই পরিমাণ লোক বেঁচে থাকবে যে পরিমাণ লোকের খাদ্য মজুদ আছে।
ম্যালথাসের এ ভবিষ্যৎ বাণী আজ আড়াইশত বৎসর পরে এসে মানব জাতিকে ভাবিয়ে তুলেছে। নভেল করোনা ভাইরাস নিয়ে সবাই এখন ভীষণ আতঙ্কে। তবে এমন ঘটনা নতুন কিছু নয়। নিয়মিতই মানুষকে নিত্যনতুন প্রাণঘাতী ভাইরাসের মোকাবেলা করতে হচ্ছে। ম্যালথাসের ভবিষ্যৎবাণী অনুসারে ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ানক বেশ কয়েকটি প্রাণঘাতী ভাইরাস মানব সভ্যতাকে আক্রমণ করেছে। তার মধ্যে নভেল করোনা ভাইরাস একটি। করোনা ভাইরাসের দুইটি প্রজাতি এর আগেও ছড়িয়েছিল। এর মধ্যে একটি হচ্ছে মার্স (মিডল ইষ্ট রেসপিরেটরি সিনড্রোম বা MRC)। আর অপরটি হচ্ছে সার্স (সিভিয়ার অ্যাকুইট রেসপিরেটরী সিনড্রোম বা CARC)। এ দুই প্রজাতির ভাইরাস মিউটেশন বা রূপান্তর ঘটার কারণে এটা এখন নভেল করোনা ভাইরাস রূপে এসেছে। এ ভাইরাস পৃথিবীতে নতুন নয়। অনাদিকাল থেকে কোন না কোন ভাইরাস মানব জাতিকে আক্রমন করেছে। কয়েক হাজার বছর ধরে মানুষের মৃত্যু ঘটানোর আরেক ভাইরাসের নাম হচ্ছে ‘স্মলপক্স’। এটি ছড়িয়েছিল মূলত ইউরোপ থেকে। হাজার বছর ধরে সেখানকার মানুষ ভাগ্যের অন্বেষণে বা বাণিজ্যের প্রসারের জন্য অথবা উপনিবেশ স্থাপনের জন্য পৃথিবীর নানা প্রান্তে পাড়ি জমিয়েছে। সঙ্গে নিয়ে গেছে এ ভাইরাস। এ ভাইরাসের সাথে বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তের মানুষ পরিচিত নই বলে ইউরোপের তুলনায় পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তের মানুষ মারা গেছে বেশি। কথিত আছে, আমেরিকা দখলের পরবর্তী উক্ত দেশের ৯০ শতাংশ আদিবাসী এ ভাইরাসে মারা যায়। বিশ্বজুড়ে এ ভাইরাসে মারা গেছে অন্তত ৩০ কোটি মানুষ।
১৯৬৯ সালে নাইজেরিয়ার বোর্নো প্রদেশে নতুন এক ভাইরাস দেখা দেয় যার নাম হচ্ছে ‘লাসা’ ভাইরাস। এক ধরণের ইঁন্দুর এ ভাইরাসের বাহন বলে মনে করা হয়। বিশেষ করে এসব ইঁন্দুরের বিষ্টা থেকে এ ভাইরাস ছড়ায়। পশ্চিম আফ্রিকায় এই ইঁন্দুরের বাস। বিশেষ করে সিয়েরা লিওন, গিনি, নাইজেরিয়া ও লাইবেরিয়ায় এ ইঁন্দুর বসবাস করে। এখনো পর্যন্ত এসব অঞ্চলে প্রতিবছরই তিন থেকে পাঁচ লাখ মানুষ ‘লাসা’ ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে। মারা যাচ্ছে গড়ে পাঁচ হাজার। এ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে শুরুতে জ্বর ও বুকে ব্যথা হয়। পরে মুখ ফুলে যায়, মস্তিষ্ক প্রদাহ হয়।
১৯৭৬ সালে কঙ্গোর ইবোলা নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে এক ধরণের ভাইরাস দেখা দেয়। পরবর্তীতে এ ভাইরাসের নাম দেয়া হয়েছে ইবোলা ভাইরাস। এতে আক্রান্ত হলে প্রথমে উপসর্গ হিসেবে দেখা দেয় মাথা ব্যথা ও গলা ব্যথা। তারপর জ্বরের সঙ্গে শুরু হয় শরীর থেকে রক্তপাত। এমন কি চোখ থেকেও ঝরতে পারে রক্ত। অকেজো হতে থাকে অঙ্গ প্রত্যঙ্গ। এরপর মৃত্যু অনিবার্য্য। এখনো এর কোন চিকিৎসা আবিষ্কার করতে পারেনি বিজ্ঞানীরা। পাঁচ রকমের ইবোলা ভাইরাস আছে। নামকরণ হয়েছে অঞ্চল অনুযায়ী। জায়ার, সুদান, তাই ফরেষ্ট, বান্দিবাইগো ও রেষ্টন- এগুলো হচ্ছে অঞ্চল ভিত্তিক ইবোলা ভাইরাসের নাম। এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর জায়ারেরটি। তাতে মৃত্যুর আশঙ্কা ৯০ শতাংশ। আশার কথা হচ্ছে, ইদানীং এসব দেশে ইবোলা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যায় না। সর্বশেষ ২০১২ সালে দেখা গিয়েছিল উগান্ডায়।
২০০২ সালের নভেম্বরে চীনের দক্ষিণের গুয়াংদং প্রদেশে এক নতুন ভাইরাস দেখা দেয় যার নাম হচ্ছে সার্স (CARC) ভাইরাস। বিশেষ করে হংকং, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম ও কানাডায় পরবর্তীতে এ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। প্রাথমিক উপসর্গ অনেকটা আর দশটা ফ্লুর মতোই। জ্বর, গা ও গলা ব্যথা, ভয়ানক ক্লান্তি প্রাথমিক অবস্থায় দেখা যায়। পরের দিকে দেখা দেয় শ্বাসকষ্ট ও নিউমোনিয়া। তারপর মৃত্যু অনিবার্য্য। এই ভাইরাস দাপট চালিয়েছিল ২০০৩ সালের জুলাই পর্যন্ত। আক্রান্ত হয় ১৭টি দেশের আট হাজারেরও বেশি মানুষ। মারা গেছে প্রায় আটশত লোক। অবশ্য বিজ্ঞানীরা দ্রুত এ ভাইরাস মোকাবেলা করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০০৪ সাল থেকে সার্স ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আর কোন খবর পাওয়া যায়নি। ২০১৭ সালে একদল চীনা গবেষক সার্স ভাইরাস উৎপত্তির রহস্য উদঘাটন করে। চীনের ইউনান প্রদেশের এক প্রজাতির বাদুড় থেকে এ ভাইরাসের উৎপত্তি।
২০১২ সালে শনাক্ত করা হয় মার্স (MRC) নামক এক প্রকার ভাইরাস। এ ভাইরাসের অস্তিত্ব প্রথমে পাওয়া যায় সৌদি আরবে। সে বছরেরই সেপ্টেম্বরে কাতারে আরেকজনের শরীরে পাওয়া যায় একই ভাইরাসের অস্তিত্ব। নভেম্বরে দুই দেশেই পাওয়া যায় আরো অনেকের দেহে। এ কারণে উক্ত ভাইরাসের নাম দেয়া হয় ‘মিডলইষ্ট রেসপিরেটরি সিনড্রোম’। সংক্ষেপে এ ভাইরাসকে বলা হয় মার্স (MRC)। পরের কয়েক বছরে এই ভাইরাস ধীরে ধীরে ২০টিরও বেশি দেশে ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, অষ্ট্রিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একে চিহ্নিত করে ‘ভবিষ্যতে মহামারি ঘটাতে সক্ষম’-ভাইরাস হিসেবে। শুরু হয় এটি নিয়ে গবেষণা। তবে এতে কতজন আক্রান্ত হয়েছে আর কতজন মারা গেছে তা সম্পর্কে জানা যায় না। কারণ নিজের দেশে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে কতজন- তা কোন দেশই প্রকাশ করতে চায়নি। তাই বেশিরভাগ দেশই চেপে গেছে সঠিক তথ্য। সুতরাং দেখা যায়, নভেলকরোনা ভাইরাস নতুন কোন ভাইরাস নয়। ম্যালথাস তত্ত্বের কার্যকারিতায় নতুন নতুন ভাইরাস মানব সভ্যতাকে আক্রমণ করছে। অর্থাৎ প্রকৃতি আপন থেকে প্রতিশোধ নিচ্ছে। কিন্তু মানব জাতিও এতে বসে নেই। এসব ভাইরাসকে নির্মূল করার জন্য গবেষণায় রত আছে হাজার হাজার বিজ্ঞানী। অধিকাংশ ভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় মানব জাতি অবশ্যই জয়ী হবে। দ্রুত আবিষ্কার করবে এর প্রতিষেধক। নির্মূল হবে সব ধরণের ভাইরাস। জয় হোক মানব জাতির এবং মানব সভ্যতার।
লেখক : পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ
ভাইরোলজি পাঠশালা : নোভেল করোনাভাইরাস (2019-nCoV)
২০২০ সাল শুরু হয় আমেরিকা-ইরানের উত্তেজনা, অস্ট্রেলিয়ায় দাবানল, ফিলিপাইনে অগ্নুৎপাতের খবর দিয়ে। সাথে চুপি চুপি আরেকটি ভয়াবহতা অপেক্ষা করছিলো। এই ভয়াবহতা হচ্ছে নতুন এক সংক্রামক রোগ। সংক্রামক রোগ মানবজাতির ইতিহাসে বারবার আক্রমণকারী অপরাজিত শত্রু। নতুন এই সংক্রামক রোগ ছড়ানোর জন্য দায়ী একটি নতুন করোনাভাইরাস। নতুন এই ভাইরাসটির নাম প্রথমে উহান ভাইরাস, পরে নোভেল করোনাভাইরাস (2019-nCoV) রাখা হয়েছে। পূর্বের সার্স ও মার্স ভাইরাসের ভয়াবহতার অভিজ্ঞতা মনে রেখে ভাইরাসবিশষেজ্ঞ, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা এই ভাইরাসের উদ্ভব নিয়ে অনেক চিন্তিত এবং সর্বাত্মক কাজ করে যাচ্ছেন ভাইরাসের বিস্তার রোধ করতে। বিভিন্ন বিজ্ঞান জার্নাল ও স্বাস্থ্যসংস্থার তথ্য-উপাত্ত থেকে বর্তমান পরিস্থিতি বর্ণনা করে এই প্রবন্ধটি লিখলাম। লেখার শেষে বাছাই করা ২০টি সূত্র রয়েছে।
যেভাবে জানা গেল নোভেল করোনাভাইরাস (2019-nCoV) এর আগমন
প্রতিবছর শীতে মানব ভাইরাস বিশেষজ্ঞরা ভয়ে ভয়ে থাকে হয় ইনফ্লুয়েঞ্জা নয়তো করোনাভাইরাসের ছোবল অপেক্ষা করছে। ২০১৯ এর ডিসেম্বরে চীনের হোবেই প্রদেশের উহান এলাকাকে থেকে খবর আসে কিছু অজানা কারণে নিউমোনিয়া আক্রান্ত কিছু রোগীর। নিউমোনিয়ার কারণটি ঠিক ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীরা ধরতে পারছিলেন না। তাই ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীরা চীনের সিডিসিকে (সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল ও প্রিভেনশন- রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র) জানায়। উহানের যে এলাকাতে প্রাদুর্ভাব সেটি সামুদ্রিক মাছ-প্রাণী ও জীবন্ত পশু-পাখি বিক্রয়ের বাজারের কাছাকাছি। সেখানে খোলা-মেলাভাবে পশু-পাখির মাংস বেচা-কেনা হয়। ৩১শে ডিসেম্বরে চীনের সিডিসির একদল গবেষক উহানে যায় পরিস্থিতি বুঝতে ও গবেষণার জন্য তথ্য-উপাত্ত-স্যাম্পল আনতে। বুঝতে বাকি থাকে না যে নতুন এক ভাইরাসের আবির্ভাব ঘটেছে। তাই গবেষকরা খুব দ্রুত কাজে নেমে যায় ভাইরাসটির পরিচয় জানতে।
অবশেষে ২০২০ সালে ২৪শে জানুয়ারিতে ড. ওয়েনজি টানের গবেষক দল নেয়জেম (নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিনে) তাদের গবেষণা প্রকাশ করে। গবেষণায় তারা জানায় এটি একটি নতুন করোনাভাইরাস, নাম দেন 2019-nCoV (২০১৯- নোভেল করোনাভাইরাস)। এর আগে এই ভাইরাসটিকে উহান ভাইরাস বলে ডাকা হচ্ছিলো। এখানে বলে রাখা ভালো, এই ভাইরাসের নাম পরে পরিবর্তন হতে পারে (আইসিটিভি ভাইরাসের অফিসিয়াল নাম দিবে)। গবেষণায় জানা যায় এটি করোনাভাইরাসের চারটি গ্রুপের বিটাকরোনাভাইরাসের অন্তর্ভুক্ত। মানুষকে আক্রান্ত করতে পারা করোনাভাইরাসের বাকি ছয়টি ভাইরাসের সাথে নতুন হিসেবে এই ভাইরাসের আবির্ভাব।
তিনজন রোগীর ব্রঙ্কোএলভিউলার লাভাজের তরলে (ফুসফুসের ব্রঙ্কাইয়ের তরল) ভাইরাসে উপস্থিতি পাওয়া যায়। গবেষক দল দাবি করেন যে নোভেল করোনাভাইরাস অজানা নিউমোনিয়া রোগের কারণ হতে পারে।
সংক্ষেপে নোভেল করোনাভাইরাস (2019-nCoV)
করোনা ভাইরাস কোন সিংগেল স্পেসিজের ভাইরাসের নাম নয়। এটা একটি ফ্যামিলি। বিভিন্ন প্রানীর দেহে এই ফ্যামিলির দুইশর বেশি ভাইরাস আবিষ্কৃত হয়েছে।
এরমধ্যে মানব দেহে পাওয়া গেছে করোনা পরিবারের ছয়টি প্রজাতির ভাইরাস। এবার চীনের উহান থেকে যে আউটব্রেকটা হয়েছে এটা সপ্তম বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে। সবগুলি ভাইরাসেরই আলাদা নাম আছে। এবারকার ভাইরাসটির নাম দেওয়া হয়েছে 2019 nCoV.
মানুষের শ্বাসনালীতে মূলত এই ভাইরাস আক্রমণ করে এবং শ্বাসনালীকে সংক্রমিত করে নিউমোনিয়ার মত লক্ষণ প্রকাশ করে। অর্থাৎ জ্বর,সর্দি,কাশি ও শ্বাসকষ্ট – এই হলো এই রোগের লক্ষণ। রোগী মারা যায় তীব্র শ্বাসকষ্ট থেকে রেসপিরেটরি ফেইলিউর হয়ে।
ইতোপূর্বে সার্স ও মার্স নামে দুটি আউটব্রেকের কথা আমরা শুনেছি। এগুলো এই করোনা পরিবারের ভাইরাসেরই কাজ।
নতুন করোনাভাইরাস বিটাকরোনাভাইরাসের অন্তর্ভুক্ত। বিটাকরোনাভাইরাসে আগে প্রাদুর্ভাব করা সার্স ও মার্স করোনাভাইরাস রয়েছে। নোভেল করোনাভাইরাসটি সিঙ্গেল-স্ট্যান্ডেড আরএনএ ভাইরাস, যার জিনোম ২৯, ৯০৩ বেইসপেয়ার। ভাইরাসটির সিকুয়েন্স ১৭ জানুয়ারিতে এনসিবিআইতে জমা দেয়া হয়। করোনাভাইরাসের জিনোম বিশ্লেষণ করে কিছু অজানা তথ্য জানা যায় এবং ভবিষ্যতে আরো অনেক কিছু জানার সুযোগ করে দেয়।
লক্ষণসমূহ:
জ্বর, কাশি, নি:শ্বাসে দূর্বলতা/শ্বাসকষ্ট, অস্থিরতা। ভাইরাসটি দ্বারা আক্রান্ত হয়ে প্রচন্ড অসুস্থ বা মৃত্যু হবার সম্ভাবনা বৃদ্ধ ও শিশুদের। সিডিসি পূর্বের মার্স করোনাভাইরাসে অভিজ্ঞতা থেকে ধারণা করেছে আক্রান্ত হবার ২ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে লক্ষণ দেখা দিবে।
কিভাবে ছড়ালো:
এই মূহুর্তে এটা নিশ্চিত করা যায় নি ঠিক কোন প্রাণী থেকে মানুষে এসেছে। যেহেতু পূর্বের গবেষণা ও অভিজ্ঞতা থেকে বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন বাদুড় থেকে আসতে পারে। বাদুড় আগে প্রাদুর্ভাব করা সার্স ও মার্সের বাহক ছিলো (বাদুড় অনেক ভাইরাস বহন করে নিজে অসুস্থ না হয়ে)। উহান প্রদেশে অনেক খোলা বাজারে জীবন্ত পশুপাখি বিক্রি হয়। অনেকে ধারণা করছেন জীবন্ত প্রাণী সংস্পর্শে (হাতে ধরা, মাংস/রক্ত/মলের সংস্পর্শ, খাওয়া ইত্যাদি) আসার কারণে হতে পারে। যেহেতু পূর্বে সার্স ভাইরাস বাদুড় ও সিভেট বিড়াল ; মার্স ভাইরাস বাদুড় ও উটের সংস্পর্শে ছড়িয়েছে, তাই অনেকে এই ধারণা করছেন। তবে বিশাল সংখ্যক আক্রান্ত ব্যক্তি খোলা বাজারে যাননি, যেটা বুঝায় ভাইরাসটি মানুষ থেকে মানুষে ছড়াতে খুবই সক্ষম (আরএনএ ভাইরাস খুব দ্রুত বিবর্তিত হতে পারে!)। ১৩ জানুয়ারিতে চীনের বাইরে থাইল্যান্ডে একজন চাইনিজ টুরিস্টেকে আক্রান্ত পাওয়া উহান প্রদেশের বাজারে সাথে কোনভাবেই সম্পর্কিত নয়।
ভাইরাসটি কি বাদুড় বা সাপ থেকে এসেছে?
করোনাভাইরাস মানুষ ছাড়াও অন্যান্য স্তন্যপায়ী (যেমন বাঁদুড়, বিড়াল, শুকর, কুকুর, গবাদি পশু, উঠ, খরগোশ), পাখি ও সাপকে সংক্রমণ করে বলে দাবি করা হয়। (সাপের ব্যাপারটা পুরোপুরি নিশ্চিত নই।) বাদুড় করোনাভাইরাসসহ বহু ভাইরাসের বাহক হিসেবে পরিচিত ও বাদুড় থেকে মানুষে বহু ভাইরাসের সংক্রমণের ইতিহাস রয়েছে (যেমন বাংলাদেশে খেজুর রসের মাধ্যমে নিপাহ ভাইরাসের মৌসুমী প্রাদুর্ভাব), সেই অনুযায়ী কিছু গবেষক ধারণা করেন নতুন এই করোনাভাইরাসটি বাদুড় থেকে আসতে পারে ধারণা করেন। অন্যদিকে একদল গবেষক নতুন এই করোনা ভাইরাসের সাথে অন্য করোনাভাইরাসে জিনোমের বিবর্তনগত বিশ্লেষণ করেন। বিবর্তনগত বিশ্লেষণ ধারণা দেয়ে একটি ভাইরাস কোন প্রজাতি থেকে এসেছে বা অন্য কোন ভাইরাসের সাথে মিল। নতুন এই করোনাভাইরাসটি বাদুড়ের সার্স করোনাভাইরাসের সাথে ৮৫% মিল রয়েছে। অন্য দিকে তারা দাবি করেন নতুন করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিন (অন্যতম একটি প্রোটিন যা ভাইরাসকে কোষ আক্রমণে সহায়তা করে) এ হোমোলোগাস রিকম্বিনেশন হয়েছে করোনাভাইরাসের আরেকটি শ্রেণী/ক্লাড থেকে। পরবর্তীতে তারা ভাইরাসের কোডন ব্যবহার অন্য প্রাণীর সাথে তুলনা করতে গিয়ে সাপের সাথে মিল পান। সেটা থেকে গবেষকরা ধারণা করেন, হয়তো সাপ থেকে মানুষে ভাইরাসটি সংক্রমিত হয়েছে। উহানের ঐ বাজারে সাপও বিক্রি হয় বলে জনশ্রুতি রয়েছে। এখানে বলে রাখা ভালো, সাপ থেকে ভাইরাসটি আসা সম্ভাব্য অনুমান. তারা সাপে ভাইরাসে উপস্থিতি দেখাননি বা দেখানোর চেষ্টাও করেননি। ল্যাবে প্রমাণিত করার চেষ্টা ঐ গবেষকরা করেননি। গবেষকদল বিবর্তরগত বিশ্লেষণ ও প্রাদুর্ভাবের তথ্যের সাথে মিল খুঁজে উক্ত সম্ভাব্য সংক্রমণের ধারণা দেন। সাপ থেকে ভাইরাসটি কিভাবে আসবে সেটা নিয়েও কিছু গবেষক সন্দিহান! যেহেতু সাপ হচ্ছে সরিসৃপ ও শীতল রক্ত বিশিষ্ট, তাদের ভাইরাস তাপমাত্রার দিকে সংবেদনশীল আর এদিকে মানুষ হচ্ছে স্তন্যপায়ী ও উষ্ণ রক্ত বিশিষ্ট, নতুন করোনাভাইরাস সাপ থেকে এসে এতো দ্রুত খাপ খাইয়ে নিতে পারার কথা নয় (যদি আরএনএ ভাইরাসের মিউটেশন ও এভ্যুলুশন অনেক বেশি)। সব মিলিয়ে কোন প্রাণী থেকে এসেছে ও কোন প্রাণীতে ভাইরাসটি প্রকৃতিতে সাধারণত থাকে সেটা নিয়ে এখনো কোন গবেষণা হয়নি।
কেন বার বার করোনাভাইরাস হানা দিচ্ছে চীন বা অন্য দেশগুলোতে?
করোনাভাইরাসের প্রাকৃতিক বাহক হচ্ছে বাদুর এবং বাদুর থেকে অন্য প্রাণীতে ছড়ায়। মানুষ যখন সেসব প্রাণীর সংস্পর্শে(স্পর্শ, মল-মূত্র, খোলা মাংস) আসে তখন সেটা মানুষে ছড়ায়। অপরিষ্কার খোলা বাজারে পশু-পাখি বিক্রয় ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ের জন্যই ঝুঁকি। কসাইখানার পরিবেশ যদি জীবাণুমুক্ত বা পরিষ্কার না হলে সহজেই বিভিন্ন জীবাণু ছড়ানোর সুযোগ থাকে। চীনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে খোলাবাজারে প্রক্রিয়াহীন মাংস বিক্রয় হয়। অনেকক্ষেত্রে জীবন্ত প্রাণী (পশু-পাখি) কিনতে চায় ক্রেতা (যাতে বিক্রেতা মৃত বা ভেজাল মাংস না দিতে পারে)। যেকারণে ভাইরাস সক্রিয় থাকা অবস্থায় ক্রেতা-বিক্রেতা ও বাজারে আসা লোকজনে ছড়ানোর সুযোগ থাকে। সেই সাথে সেইসব দেশে জনসংখ্যা ও জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি থাকায় একজন থেকে আরেকজনে ছড়ানো সুযোগ থাকে। আর এতো মানুষের মধ্যে কিছু লোক থাকবে যাদের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা দূর্বল (যেমন বৃদ্ধ, শিশু ও অন্য রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি)। দুর্বল রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতার লোকদের আক্রান্ত করে ভাইরাস মিউটেশন করে বিবর্তিত হয়ে আরো ভয়ানক হয় ও বেশি ছড়ানোর বৈশিষ্ট্য অর্জন করে। একই সাথে মানুষের অসেচতনা, ডাক্তারদের কাছে না যাওয়া ও অবহেলা এইরকম ভাইরাস ছড়ানোতে সাহায্য করে। নিচের মিম চিত্রে কৌতুক করে সহজে বুঝানো হয়েছে কিভাবে অপরিষ্কার বাজারে খোলা অবস্থায় পশু-পাখি বিক্রয়ের মাধ্যমে নতুন নতুন ভাইরাস মানুষে প্রাদুর্ভাব করে।
ধন্যবাদান্তে
মীর মুবাশ্বির খালিদ
ভিজিটিং গ্রাড
স্টুডেন্ট, গ্লাডস্টোন ইন্সস্টিটিউট
অব ভাইরোলজি এন্ড
ইমিউনোলজি, ইউসিএসএফ, সান
ফ্রান্সিসকো, যুক্তরাষ্ট্র।
পিএইচডি ক্যান্ডিডেট, ইরাসমাস মেডিকেল
সেন্টার, ডি.
অব বায়োকেমিস্ট্রি, ইরাসমাস ইউনিভার্সিটি,
রটারডাম, নেদারল্যান্ডস।
৩৮০ বার জিন বদলে আরও শক্তিশালী করোনা, ঘুম হারাম বিজ্ঞানীদের
বারবার নিজের জিন বদলে উত্তরোত্তর শক্তিশালী হয়ে উঠছে করোনা ভাইরাস। এরই মধ্যে সে টিকে থাকার স্বার্থে ৩৮০ বার নিজের জিন বদলে ফেলেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, কোভিড-১৯ এর এই জিন মিউটেশনই ভ’য়ের আসল কারণ। যার ফলে বিশ্বের সব বিজ্ঞানীদের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। আত’ঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে আমজনতার মধ্যেও। মাঝেই মাঝেই শোনা যাচ্ছে এবারে এই ভাইরাসকে জ’ব্দ করা যাবে ভ্যাক্সিন দিয়ে। কিন্তু প্রতিষেধক কতটা কাজের কাজ করতে পারবে সেই নিয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরাও চিন্তায় পড়েছেন।
হিউম্যান প্যাথোজেনিক ভাইরাসের সংক্র’মণজনিত রোগ গবেষকদের মতে, এত কম সময়ের মধ্যে ঘন ঘন জিন মিউটেশন করে নিজের চরিত্র বদলে ফেলছে এই ভাইরাস। তাই একে ঠেকাতে সুনির্দিষ্ট কোনও ও’ষুধ ব্যবহার করা মুশকিল।
প্রায় দু’দশক ধরে করোনা গোত্রেরই ভাইরাস নিয়ে চিকিৎসকরা চিন্তিত। চীনের উহান থেকে দ্রুত ছড়িয়ে পড়া এই কোভিড-১৯ ভাইরাসের ১৮ বছর আগে সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম বা সার্সও ঘুম কেড়ে নিয়েছিল চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের। সার্স রোগাক্রা’ন্তদের মধ্যে মা’রা পড়তেন প্রায় ১০ শতাংশ। মার্স বা মিডল ইস্ট রেসপিরেটরি সিনড্রোমও ২০১২ সালে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। তখন দ্রুত ভ্যাক্সিন তৈরি করে তার সাহায্যে রোগের বাড়বাড়ন্ত আটকে দেয়া হয়।
কোভিড-১৯ সেই গোত্রেরই জীবাণু। তবে আগের ভাইরাসদের থেকে এর কিছু চরিত্রগত তফাৎ আছে। তাই প্রতিষেধক নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চললেও কোনও কার্যকর ভ্যাক্সিন বা ও’ষুধ বানানো মুশকিল হয়ে পড়ছে।
গবেষকরা এখন হোস্ট ডিরেক্টেড থেরাপির কথা ভাবছেন। ব্যাপারটা হলো, মানুষের জিনের যে প্রোটিনের উপর কোভিড-১৯ ভাইরাস বেড়ে ওঠে, তাকে নি’ষ্ক্রিয় করে দেয়া। তাদের ধারণা, তা হলেই হয়তো এই ভাইরাসের জারিজুরি শেষ হবে।
নভেল করোনা ভাইরাসের চরিত্রগত বিশ্লেষণ করে ইতিমধ্যই গবেষকরা বেশ কিছু বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করেছেন।
কোভিড-১৯ ঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু হলে, শরীরে রোগ প্র’তিরোধ ক্ষমতা ক্রমেই বাড়িয়ে চললে শিশুদের বিশেষ কোনও ক্ষ’তি করতে পারে না। এই ভাইরাসের কবলে পড়লেও শিশুরা ক্রমশ সুস্থ হয়ে ওঠে। শিশুদের তুলনামূলকভাবে পরিচ্ছন্ন পরিবেশে রাখা হলে সংক্র’মণের ঘটনাও কমবে বলে মনে করা হচ্ছে।
নারীরাও কোভিড-১৯ ভাইরাসের থাবা থেকে কিছুটা নিরাপদ। এর কারণ হিসেবে মনে করা হচ্ছে, মেয়েদের মধ্যে অটোইমিউন ডিজিজের (শ্বেতী, এসএলই, থাইরয়েড ইত্যাদি) প্রবণতা বেশি হওয়ায় কোভিড-১৯ এর বিরু’দ্ধে যু’দ্ধে তারা বেশির ভাগ সময়ই জিতে যান। শরীর কোনও না কোনও অ্যান্টিবডি তৈরি করে ফেলে। তাই আক্রা’ন্ত মেয়েদের মৃ’ত্যুহার অনেক কম।
ধূমপায়ী পুরুষদের মধ্যে এই অসুখের মা’রাত্মক প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে। মনে করা হচ্ছে যে, ধূমপানের ফলে শ্বাসনালী ও ফুসফুসের লাইনিং কিছুটা দুর্বল থাকে। তাই কোভিড-১৯ ভাইরাস এদের শ্বাসনালী ও ফুসফুসকে আক্র’মণ করে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
কোভিড-১৯ আক্রা’ন্ত অতি বয়স্কদের মৃ’ত্যুর হার সব থেকে বেশি। কারণ এদের শরীরে রোগ প্র’তিরোধ ক্ষমতা কম হয়।
কোভিড-১৯ ভাইরাসের বড় সড় সংক্র’মণে শুধুই যে শ্বাসনালী ও ফুসফুস আক্রা’ন্ত হয় তা নয়, ইন্টেস্টাইনের আবরণ একেবারে ন’ষ্ট করে দেয়। শরীরে অক্সিজেনের পরিমাণ হু হু করে কমে যেতে শুরু করে। ক্রমশ মাল্টি অরগ্যান ফেলিওরের দিকে এগোতে থাকে।
ক্স কিছু কিছু অ্যান্টিভাইরাল ও’ষুধ ব্যবহার করা হলেও খুব যে কার্যকর তা এখনও বলা যাচ্ছে না।
অনেকেরই ধারণা, গরম পড়লে কোভিড-১৯ ভাইরাসের দাপট কমবে। কিন্তু এই ভাইরাসের জিন মিউটেশনের ধরন দেখে এখনই এ বিষয়ে কিছুই বলা যাচ্ছে না।
কোভিড-১৯-এর হাত থেকে বাঁচতে ন্যুনতম ২০ সেকেন্ড ধরে সাবান দিয়ে হাত ধুতেই হবে। হাত ধুলে এনভেলপ ফ্লু জাতীয় কোভিড-১৯ ভাইরাসকে নি’শ্চিহ্ন করা সম্ভব। পানি না থাকলে ৬০–৭০ শতাংশ ইথাইল অ্যালকোহল-যুক্ত স্যানিটাইজার দিয়ে ভালো করে হাত পরিষ্কার করে নেয়া উচিত। ভাইরাসের বিরু’দ্ধে ল’ড়তে টাটকা শাকসব্জি ও ফল খেতে হবে। ধুমপান ও মদ্যপান ছাড়তে হবে।
Discussion about this post