একটি দেশের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হচ্ছে সেই দেশের স্বাধীনতা। পরাধীন জাতীর কোনো গৌরব নেই। স্বাধীনতা একটি জাতিকে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন করে তোলে। তাই আমাদের জাতীয় জীবনে ছাব্বিশে মার্চ এর গুরুত্ব অত্যাধিক। ১৯৭১-এর এই দিনে দীর্ঘ পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্তির লক্ষ্যে ঘোষিত হয়েছিল স্বাধীনতা, শুরু হয়েছিল সশস্ত্র প্রতিরোধ ও মুক্তিযুদ্ধ। বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসে এই দিনটি অত্যন্ত তাৎপর্যমণ্ডিত ও গুরুত্ববহ। আজ স্বাধীনতার ৪৯তম বার্ষিকী।
কভিড-১৯ এর আতঙ্ক দেশজুড়ে থাকলেও আজকের দিনে বাঙালি জাতি স্মরণ করবে ইতিহাসের সেই রক্তরাঙা সময়কে।১৯৭০-এ তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন নিয়ে জয় লাভ করে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক জান্তা বাঙালিদের হাতে শাসনভার তুলে দেওয়ার পরিবর্তে শুরু করে নানা ষড়যন্ত্র। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ১লা মার্চ পূর্ব নির্ধারিত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বন্ধ ঘোষণা করলে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসন চলতে থাকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে। সাতই মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে দেয়া ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু আহ্বান জানান মুক্তিসংগ্রামের। এরপর এল ২৫শে মার্চের কালরাত্রি। পাকিস্তানি সেনাবাহিনি পূর্ববাংলার নিরস্ত্র-নিরীহ জনগণের ওপর সশস্ত্র আক্রমণ ঘটালো রাতের অন্ধকারে। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হলো। গ্রেফতারের আগে তিনি দেশবাসীর উদ্দেশ্যে একটি ঘোষণাপত্র পাঠালেন। ২৬শে মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত হলো স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতার আন্দোলন হঠাৎ ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা নয়। বাংলার মুক্তিকামী জনগণের জীবনে একাত্তরের ছাব্বিশে মার্চ এসেছিল বহু ত্যাগ আর আত্মদানের বিনিময়ে। ৫২-র ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ৫৪-র সাধারণ নির্বাচন, ৬২-র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬-র ছয় দফা আন্দোলন, ৬৯-এর গণ অভ্যুত্থান, ৭০-এর নির্বাচন, ৭১-এর রক্তাক্ত মার্চ – এমনই একের পর এক আন্দোলন সংগ্রামের সিঁড়ি ডিঙ্গিয়ে তা কাঙিক্ষত স্বাধীনতায় রূপ পেল ১৯৭১ সালের ছাব্বিশে মার্চ। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ঐক্যবদ্ধ সশস্ত্র প্রতিরোধে – সূচনা হয়েছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের। ১৯৭১-এ বাংলাদেশে পাকবাহিনি ও এদেশীয় দোসরদের পরিচালিত গণহত্যায় প্রাণ বলিদান ঘটেছিল ত্রিশ লাখ মানুষের, লাঞ্ছিত হয়েছিল তিন লক্ষাধিক নারী আর দেশ ত্যাগ করে উদ্বাস্তু হতে হয়েছিল প্রায় এক কোটি মানুষকে।
এবারের মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস এমন এক সময়ে উদযাপিত হচ্ছে, যখন স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীও উদযাপিত হচ্ছে। মাত্র ৯ দিন আগে শুরু হয়েছে ‘মুজিববর্ষ’। আজকের এ দিনে জাতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও গভীর কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করছে স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় চার নেতা- সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, মোহাম্মদ কামারুজ্জামানসহ মুক্তিযুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী দেশমাতৃকার অগণিত বীর সন্তান এবং সহায়-সম্পদ হারানো, হত্যা-গণহত্যা ও ধর্ষণের শিকার সবাইকে।
স্বাধীনতা দিবস তাই একদিকে ত্যাগ আর বেদনায় মহীয়ান, অন্যদিকে বাঙালির আত্মপরিচয়ের গৌরবে সমুজ্জ্বল।তাই মহান স্বাধীনতা দিবসের এই ক্ষণে আমাদের সবাইকে প্রত্যয় গ্রহণ করতে হবে সকল ধরনের অন্যায়-অবিচার, শোষণ,বঞ্চনা, দূর করে আমাদের এই মাতৃভূমিকে আমরা সোনার বাংলা হিসাবে গড়ে তুলব। যেদিন সমাজের বুক থেকে অন্যায়-অসত্য দূর হবে, সুশিক্ষায় সুশিক্ষিত হয়ে বিশ্বের বুকে মাথা উচু করে দাঁড়াবে -সেইদিন শহীদদের আত্নত্যাগ স্বার্থক হবে।একাত্তরের এই দিনে এ দেশের মুক্তিপাগল দামাল সন্তানরা যেমন আকাশজুড়ে ছড়িয়ে দিয়েছিল স্বাধীনতার লাল সূর্যের আলো, তেমনি এবারের স্বাধীনতা দিবসে জনগণ শপথ নিচ্ছে ক্রান্তিকাল পেরিয়ে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার; করোনাভাইরাসকে পরাস্ত করে বিশ্ব মানচিত্রে আবারও মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার।
Discussion about this post