এখন দেশে করোনাভাইরাসের হটস্পট নারায়ণগঞ্জ। এই জেলাতে একদিকে যেমন আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে অন্যদিকে এ জেলা থেকে দেশের বিভিন্ন জেলায় সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার প্রমানও পাওয়া যাচ্ছে। ফলে উদ্বেগ-উৎকন্ঠা পুরো জেলা জুড়ে। বিপর্যস্ত স্বাভাবিক জীবন-যাত্রা। সারাদেশের অন্তত ১৫টি জেলায় সংক্রমিত প্রথম ব্যক্তি নারায়ণগঞ্জ ফেরত। নারায়ণগঞ্জ থেকে গ্রামের বাড়ি পালাচ্ছে বিভিন্ন জেলার মানুষ। আবার প্রতিরাতেই পালাতে গিয়ে পুলিশের হাতে আটকও হচ্ছে।
এছাড়া রোববার সকাল সাড়ে ৮টা পর্যন্ত জেলা স্বাস্থ্য সেবার তথ্যমতে, এ জেলায় করোনায় মৃত্যের সংখ্যা ২৬। আর আক্রান্ত হয়েছেন ৩৩০। কিন্তু নারায়ণগঞ্জে এমন পরিস্থিতি কেনো? প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এখন পর্যন্ত কিছু বলা না হলেও এর নেপথ্যে প্রধানত পাঁচটি কারণকে দুষছেন সংশ্লিষ্টরা।
এরমধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হচ্ছে, ঘনবসতি ও শ্রমিক অধ্যুষিত এলাকা, বিদেশ ফেরত বিশেষ করে ইতালি ফেরত প্রবাসীদের অবস্থান পুরোপুরি চিহ্নিত করতে না পারা, করোনায় প্রথম মৃত নারীর লাশ কুর্মিটোলা থেকে প্যাকেটবন্দি করে দেয়ার পর সেই প্যাকেট খুলে লাশের গোসল দেয়া, আক্রান্ত ব্যক্তির অবাধ বিচরণ, ৪ এপ্রিল লাখো গার্মেন্টস শ্রমিকের নারায়ণগঞ্জে প্রবেশ, লকডাউনে বিলম্ব এবং প্রশাসনের উদাসীনতা। এমন তথ্যই পাওয়া গেছে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে।
তবে এখনো হটস্পটের প্রধান কারণ নির্ণয় করতে পারেনি বলে জানান জেলার সিভিল সার্জন।
যেসব কারণে হটস্পট নারায়ণগঞ্জ
প্রথমত: আইইসিডিআর এর তথ্যমতে, দেশে প্রথম ২ পুরুষ ও এক নারী করোনা শনাক্ত হয় গত ৮ মার্চ। পুরুষ দুইজন ইতালি প্রবাসী। স্বামীর সংস্পর্শে এসে ওই নারী সংক্রামিত হয়। তারা তিনজনই নারায়ণগঞ্জ শহরের ব্যস্ততম ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র টানবাজার এলাকায় আল জয়নাল প্লাজায় থাকতো। যদিও পরবর্তীতে তারা সুস্থ হয়েছেন। প্রবাসী এই ব্যক্তি বিদেশ থেকে আসার ৫দিন পর তার করোনা পজেটিভ আসে। এই ৫দিন সে তার আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের সাথে মিশেছে। হোটেল-রেস্তোরায় গিয়েছে। শহর ঘুরে বেড়িয়েছে। শপিংয়ে গিয়েছে স্ত্রীকে নিয়ে। মোটকথা যত জায়গায় ওই ৫দিন সে গিয়েছে সব জায়গায় সে ভাইরাসটি ছড়িয়েছে। কিন্তু কোথায় কোথায় এবং কার কার মধ্যে এটা ছড়িয়েছে তা চিহ্নিত করা হয়নি।
দ্বিতীয়ত: ৩০ এপ্রিল করোনার উপসর্গ নিয়ে কুর্মিটোলা হাসপাতালে প্রথম মারা যায় নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের বন্দরে ২৩নং ওয়ার্ডের রসুলবাগে পুতুল (৫০) নামে এক নারী। ২ এপ্রিল তার নমুনা পরীক্ষায় করোনা পজেটিভ আসে। কিন্তু এই নারী অসুস্থ থাকা অবস্থায় নারায়ণগঞ্জ জেনারেল (ভিক্টরিয়া) হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। সেখানে তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। হাসপাতালের সেবা প্রদানকারী চিকিৎসক, নার্স, এ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার, প্রাইভেট ল্যাবের টেকনিশিয়ান, এক্সরে টেকনিশিয়ান, আয়া ও চেম্বার এসিস্ট্যান্ট আক্রান্ত হয়েছেন। অসুস্থ্য অবস্থায় তিনি শহরের পাইকপাড়ায় তার বাপের বাড়িতেও গিয়েছেন। সেখানে যারাই তার সংস্পর্শে এসেছে তারা সবাই সংক্রামিত হয়েছে। এখানেই শেষ নয়। কুর্মিটোলায় মারা যাওয়ার পর ওই নারীর মরদেহ সেখান থেকে প্যাকেটবন্দি করে বলে দেয়া হয় প্যাকেট যাতে না খোলা হয়। এবং প্যাকেটবন্দি অবস্থায় দাফন করার জন্য নির্দেশনা দিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু স্বজনরা বাড়িতে লাশ আনার পর প্যাকেট থেকে মরদেহ বের করে ফেলে। এসময় স্বজননা লাশ স্পর্শ করে কান্নাকাটি করে। প্রতিবেশীরা লাশ দেখেতে বাড়িতে আসে।
তৃতীয়ত্ব: ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষনা করে। এতে করে বাংলাদেশ নিট ওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারাস অ্যান্ড এক্সপোর্টার অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ) ও বিজেএমইএ গত ২৯ মার্চ জরুরি সভা করে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত গার্মেন্টস বন্ধ ঘোষণা করে। ছুটি বাড়ানোর ঘোষণা না দেওয়ায় কর্মস্থলে যোগ দিতে করোনার ঝুঁকি মাথায় নিয়েই পায়ে হেঁটে, রিকশা-ভ্যান ও পণ্যবাহী ট্রাকে চড়ে হাজার হাজার শ্রমিক নারায়ণগঞ্জ চলে আসেন। হাজারো শ্রমিকের সমাগমে অনেকেই সংক্রামিত হয়। যার প্রমান বিভিন্ন জেলায় আক্রান্ত হওয়া প্রথম ব্যক্তি নারায়ণগঞ্জ ফেরত।
চতুর্থত: নারায়ণগঞ্জের প্রশাসনের উদাসীনতা। কারণ ৬ হাজার ২১ জন প্রবাসী শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলায় প্রবেশ করে। সবশেষ তথ্য অনুযায়ী নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন মাত্র ১ হাজার ২৫৯ জনের নাম ঠিকানা ও অবস্থান চিহ্নিত করতে পেরেছে। এবং তাদের হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করেন। কিন্তু বিপুল সংখ্যক প্রবাসী হোম কোয়ারেন্টাইনের বাইরে রয়ে যায়। তাদের অবাদ বিচরণ বিভিন্ন এলাকার মানুষকে সংক্রামিত করেছে।
পঞ্চমত: সরকারের সাধারণ ছুটির পরও জেলার বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন ফ্যাক্টরী চালু ছিল, এখনো আছে। ওই সব ফ্যাক্টরীতে হাজারো শ্রমিকের মধ্যে কোন প্রকার সামাজিক দুরুত্ব বজায় রাখা হয়নি। ফলে একজন শ্রমিক সংক্রামিত হয়ে থাকলে সে আরো অনেককেই সংক্রামিত করেছে। এছাড়া কাচাবাজারে বিপুল পরিমান ক্রেতা-বিক্রেতার সমাগম নিয়ন্ত্রনে প্রশাসন থেকে কার্যকরী কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। আবার ত্রাণ বিতরণ করার সময়ও ত্রাণদাতারা অসংখ্য মানুষের সমাগম ঘটিয়েছে লকডাউনের আগে। তখন একে অপরের সংস্পর্শে এসে অনেকেই সংক্রামিত হয়েছে। লকডাউন ঘোষণার ক্ষেত্রেও বিলম্ব হয়েছে। লকডাউন ঘোষণা করা হলেও অনেকে তা মানছেন না।
এ বিষয়ে জেলা সিভিল সার্জন (ভারপ্রাপ্ত) ডা. ইকবাল বাহারের সঙ্গে যোগযোগ করা হলে তিনি জানান, কেনো নারায়ণগঞ্জ হটস্পট কারণটা আমরা এখনো নির্ণয় করতে পারিনি। তবে আমার ধারণা নারায়ণগঞ্জ একটা ঘণবসতিপূর্ণ এবং শ্রমিক অধুষ্যিত এলাকা। অল্প জায়গায় মানুষ বেশি। নারায়ণগঞ্জে অনেক ইতালি ফেরত মানুষ আছে। ওদেরকে সত্যিকার অর্থে আমরা চিহ্নিত করতে পারি নাই। বাংলাদেশে প্রথম যে করোনা রোগী পাওয়া গেছে সেটা নারায়ণগঞ্জে। তিনি কিন্তু ইতালি ফেরত ছিলেন। ইতালি থেকে আসার ৫ দিন পর তার করোনা ধরা পড়ছে। কিন্তু এই ৫দিনে সে নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা চুষে ফেলছে। নারায়ণগঞ্জের হোটেলে গেছে, রেস্তোরায় গেছে, দোকানে গেছে, বাজারে গেছে, আত্মীয়-স্বজনদের বাসা বাড়িতে গেছে। পরিবারের সঙ্গে মিশছে। তাহলে সে এই সব জায়গায় ছড়িয়েছে। যেহেতু এটা ছোঁয়াছে একটি ভাইরাস। এছাড়া অন্যান্য যে সকল ইতালি ফেরত ছিল তাদের অনেকেই হয়তো করোনা বহন করে নিয়ে এসেছে। তাদের পুরো পুরি চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি
Discussion about this post