রতন বড়ুয়া
করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় চট্টগ্রামে সরকারি দুটি হাসপাতাল নির্ধারণ করে করোনা মোকাবেলায় গঠিত জেলা পর্যায়ের কমিটি। এর একটি ফৌজদারহাটের বিআইটিআইডি হাসপাতাল, অপরটি চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল। করোনা রোগীদের চিকিৎসায় প্রস্তুতি হিসেবে বিআইটিআইডি হাসপাতালের ৫০টি এবং জেনারেল হাসপাতালের ১০০টি আইসোলেশন শয্যা প্রস্তুত রাখা হয়েছে। হাসপাতাল দুটিতে এরই মধ্যে করোনা আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসাসেবাও শুরু হয়েছে। দুটি হাসপাতালের আইসোলেশনে গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ৪২ জন ভর্তি ছিলেন বলে সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে। যদিও দুটির একটিতেও বর্তমানে আইসিইউ-ভেন্টিলেটর সুবিধা নেই। তবে জেনারেল হাসপাতালের জন্য সমপ্রতি ভেন্টিলেটরসহ ১০টি আইসিইউ বেড বরাদ্দ দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
জেনারেল হাসপাতালে আইসিইউ সুবিধা : হাসপাতাল প্রশাসন জানিয়েছে, ভেন্টিলেটরসহ এসব আইসিইউ স্থাপনের কাজ মোটামুটি শেষ। তবে মনিটর স্থাপনের কাজ বাকি রয়েছে। যা আজ বুধবার শেষ হবে। আর মনিটর স্থাপনের কাজ শেষে আগামীকাল বৃহস্পতিবার থেকে ১০টি শয্যায় আইসিইউ সেবা দেয়া যাবে বলে জানিয়েছেন জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. অসীম কুমার নাথ।
অকেজো ৮টি আইসিইউ চালুর চেষ্টা : মন্ত্রণালয় থেকে সমপ্রতি বরাদ্দ পাওয়া এই ১০টির পাশাপাশি ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ঠিকাদার কর্তৃক রেখে যাওয়া আরো ৮টি আইসিইউ এবং ভেন্টিলেটর স্থাপন করতে চায় জেনারেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কেনাকাটায় দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় ভেন্টিলেটরসহ এসব আইসিইউ দীর্ঘ সময় ধরে হাসপাতালে পড়ে আছে। এ নিয়ে মামলাও রয়েছে। তবে দীর্ঘ সময় পড়ে থাকা এসব ভেন্টিলেটর-আইসিইউ স্থাপনপূর্বক চালুর বিষয়ে নির্দেশনা চেয়ে গত ১২ এপ্রিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর চিঠি দেয় জেনারেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. অসীম কুমার নাথ স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চাওয়া হয়। তবে গতকাল পর্যন্ত এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. অসীম কুমার নাথ। অবশ্য, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা না পেলেও এই ৮টি আইসিইউ-ভেন্টিলেটর স্থাপনের জন্য আলাদা একটি কক্ষ প্রস্তুত করার কাজ চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা কক্ষ প্রস্তুত করে রাখছি। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা পেলে এই ৮টি আইসিইউ-ভেন্টিলেটরও যাতে দ্রুত স্থাপন করা যায়।
পড়ে থাকা এই ৮টি ভেন্টিলেটর-আইসিইউ স্থাপন করা সম্ভব হলে সব মিলিয়ে ১৮টি ভেন্টিলেটর-আইসিইউ শয্যার সেবা দেয়া যাবে জেনারেল হাসপাতালে। যা চট্টগ্রামের যেকোনো পর্যায়ের হাসপাতালের তুলনায় সর্বোচ্চ সংখ্যক। চট্টগ্রামে সর্বোচ্চ সংখ্যক আইসিইউ সুবিধা রয়েছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে। হাসপাতালটিতে বর্তমানে ১২টি আইসিইউ বেড চালু রয়েছে।
জনবল : চালু হওয়ার অপেক্ষায় থাকলেও আইসিইউ পরিচালনায় চিকিৎসকসহ প্রশিক্ষিত যে জনবল প্রয়োজন, তা জেনারেল হাসপাতালে নেই। তাছাড়া করোনা রোগীর সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকায় সেক্ষেত্রে আরো জনবলের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। সব মিলিয়ে আইসিইউ পরিচালনা ও করোনা রোগীর চিকিৎসায় চিকিৎসক-নার্সসহ আরো শতাধিক জনবল প্রয়োজন বলে জানিয়েছে হাসপাতাল প্রশাসন। জনবল চেয়ে ইতোমধ্যে বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের দফতরে চিঠিও দেয়া হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত জনবল পায়নি হাসপাতালটি।
হাসপাতাল প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ২৪ জন চিকিৎসক, ৪৮ জন নার্স, ২০ জন কর্মচারী ও ১০ জন সুইপারসহ সব মিলিয়ে ১০২ জন জনবল চেয়ে গত সপ্তাহে বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক বরাবর চিঠি পাঠানো হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইসিইউ পরিচালনা একটি টিমগত কাজ। এর জন্য অ্যানেসথেসিস্টসহ প্রশিক্ষিত নার্স ও অন্যান্য সাপোর্টিং জনবল অবশ্যই প্রয়োজন। প্রশিক্ষিত জনবল ছাড়া আইসিইউ পরিচালনা সম্ভব নয়। কিন্তু আগে থেকে আইসিইউ সুবিধা না থাকায় এ ধরনের জনবল নেই জেনারেল হাসপাতালে। যার কারণে আইসিইউর জন্য অ্যানেসথেসিস্টসহ প্রশিক্ষিত জনবল চাওয়া হয়েছে। কিন্তু চাহিদামতো জনবল না পাওয়ায় বিদ্যমান জনবলেই আইসিইউর সেবা চালু করতে হবে বলে জানায় হাসপাতাল প্রশাসন।
উল্লেখ্য, করোনা রোগীদের চিকিৎসাসেবায় বিদ্যমান চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মীদের নিয়ে ইতোমধ্যে চারটি বিশেষ টিম গঠন করেছে জেনারেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে দুটি টিমে ৬ জন করে এবং বাকি দুটি টিমে ৫ জন করে সদস্য রয়েছেন। এর মধ্যে কয়েকটি টিমের মোট ১৭ জন স্বাস্থ্যকর্মী টানা ৭ দিন এখানে দায়িত্ব পালন করছেন। ৭ দিন দায়িত্ব পালন শেষে চিকিৎসকসহ এসব স্বাস্থ্যকর্মীকে ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইনে (আলাদা) থাকতে হচ্ছে। এ সময়ে তারা পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে দূরে থাকবেন। অন্য কারো সাথেও মিশবেন না। আক্রান্ত রোগীর সেবায় নিয়োজিত থাকায় সংক্রমণের আশঙ্কায় এসব স্বাস্থ্যকর্মীকে আলাদা রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। রোগীর সংখ্যা বাড়লে বিশেষ টিমের সংখ্যাও আনুপাতিক হারে বাড়াতে হবে। আর করোনা রোগীর চিকিৎসায় এ ধরনের আরো তিনটি টিম গঠনের লক্ষ্যে জনবল চাওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক।
বিআইটিআইডি হাসপাতাল : ৫০টি আইসোলেশন শয্যা প্রস্তুতের কথা বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে ২৮টি শয্যা রয়েছে এই হাসপাতালে। বর্তমানে একমাত্র বিআইটিআইডির ল্যাবেই করোনার নমুনা পরীক্ষা কার্যক্রম চলমান রয়েছে। তবে নমুনা পরীক্ষার পাশাপাশি করোনা আক্রান্ত রোগীদের রেখে চিকিৎসাও দেয়া হচ্ছে। তবে আইসিইউ-ভেন্টিলেটরের সুবিধা এ হাসপাতালে নেই। রয়েছে জনবলের স্বল্পতাও। করোনা রোগীর চিকিৎসায় ৮টি বিশেষ টিম গঠনের কথা জানায় বিআইটিআইডি হাসপাতাল প্রশাসন। এ লক্ষ্যে চিকিৎসক-নার্সসহ সব মিলিয়ে প্রায় অর্ধশত জনবল চেয়ে বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক বরাবর চিঠি দেয়া হয়। কিন্তু কিছু সংখ্যক জনবল পেলেও তা পর্যাপ্ত নয় বলে সশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
বিআইটিআইডি সূত্রে জানা গেছে, বিশেষায়িত হাসপাতালটিতে বর্তমানে ৮ জন কনসালটেন্ট ও ১৮ জন মেডিকেল অফিসার আছেন। যারা করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দিতে সক্ষম। তবে বিশেষায়িত টিম গঠনের ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের এ সংখ্যা পর্যাপ্ত নয় বলে মনে করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তাই করোনা রোগীদের চিকিৎসায় আরো ২০ জন কনসালটেন্ট এবং ৩০ জন মেডিকেল অফিসার চাওয়া হয়। চিঠির পর নতুন করে ১২ জন চিকিৎসক পাওয়া গেছে বলে জানান বিআইটিআইডির পরিচালক ডা. এম এ হাসান।
৬ সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটি : করোনা পরীক্ষা ও চিকিৎসায় ৬ সদস্যের সমন্বয়ে বিশেষজ্ঞ একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে এ হাসপাতালে। এ কমিটির প্রধান হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মামুনুর রশীদ। করোনা রোগীদের চিকিৎসায় বিশেষায়িত টিম গঠনের বিষয়ে তিনি জানান, অন্তত একজন কনসালটেন্ট, ৩ জন মেডিকেল অফিসার ও ৩/৪ জন নার্সসহ মোট ৭/৮ জন নিয়ে একেকটি টিম। এসব টিম দৈনিক ১২ ঘণ্টা কাজ করবে। আর টানা ১০ দিনের দায়িত্ব পালন শেষে প্রতিটি টিমকে ১৪ দিনের জন্য কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হচ্ছে। অর্থাৎ ওই টিমের সদস্যরা টানা দশ দিন দায়িত্ব পালন করবেন। এরপর তারা সবাই কোয়ারেন্টাইনে চলে যাবেন। এই সময়টাতে তারা যাতে কারো সংস্পর্শে না যান। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন মেনেই এমন সতর্কতা। কারণ, রোগীর চিকিৎসা দিতে গিয়ে সংক্রমণের ঝুঁকি একদম উড়িয়ে দেয়া যায় না।
বেসরকারি পর্যায়ে চিকিৎসা : সরকারি দুটি হাসপাতালের পাশাপাশি নগরীতে বেসরকারি পর্যায়েও একটি হাসপাতালকে শুধু করোনা রোগীর চিকিৎসায় প্রস্তুত করা হচ্ছে। বেশ কিছুদিন সেবা কার্যক্রম বন্ধ থাকা খুলশী এলাকার বেসরকারি হলি ক্রিসেন্ট হাসপাতালকে করোনা রোগীর চিকিৎসার জন্য প্রস্তুত করে তোলা হচ্ছে। শুধু করোনা রোগীর চিকিৎসায় ডেডিকেটেড করে হাসপাতালটি প্রস্তুত করে তোলার এই উদ্যোগ বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার মালিক সমিতির। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ও স্বাস্থ্য প্রশাসন এই উদ্যোগে সহায়তা করছে। হাসপাতালটি প্রস্তুতের কাজ ত্বরান্বিত করতে এবং কার্যক্রম সমন্বয়ে একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে। সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন এ কমিটির আহ্বায়ক। আর সদস্য সচিব করা হয়েছে বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার মালিক সমিতি চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক ডা. লিয়াকত আলী খানকে।
৮০টি আইসোলেশন শয্যার পাশাপাশি প্রাথমিকভাবে ভেন্টিলেটরসহ ১২টি আইসিইউ শয্যার ব্যবস্থা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ডা. লিয়াকত আলী খান। আগামী ২৫ এপ্রিল থেকে হাসপাতালটির সেবা চালু করা যাবে জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের আইসোলেশন শয্যাগুলো প্রস্তুত। আর ২৩ বা ২৪ এপ্রিলের মধ্যে ভেন্টিলেটর-আইসিইউ শয্যাগুলোও স্থাপনের কাজ শেষ করতে পারব বলে আশা করছি। বেসরকারি হাসপাতালগুলো থেকেই একটি করে ভেন্টিলেটর-আইসিইউ নিয়ে এখানে স্থাপন করা হচ্ছে। ২৫ এপ্রিল থেকে এই হাসপাতালে করোনা রোগীর চিকিৎসাসবা চালু হবে বলে জানান তিনি।
জনবলের বিষয়ে বলেন, আমরা বেসরকারিভাবে কিছু জনবল দিচ্ছি। তবে জনবলের সার্বিক বিষয়টি স্বাস্থ্য বিভাগ (বিভাগীয় পরিচালকের দফতর) দেখছে। সেখান থেকে রোস্টার করে দায়িত্ব বণ্টন করে দেয়া হবে। অবশ্য, সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি বলেছেন, হাসপাতালটির জনবল মূলত বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক মালিক সমিতিই সরবরাহ করবে।
এদিকে, প্রাথমিকভাবে বেসরকারি এই হাসপাতালটি প্রস্তুত করলেও প্রয়োজন হলে আরো একাধিক হাসপাতাল করোনা রোগীর চিকিৎসায় ডেডিকেট করে প্রস্তুত করে তোলা হবে বলে জানান ডা. লিয়াকত আলী খান। তিনি বলেন, পাঁচলাইশের ফরটিসও আমরা বিবেচনায় রেখেছি। প্রয়োজনে সেটিও প্রস্তুত করা হবে।
চালু হয়েছে ফিল্ড হাসপাতাল : করোনা রোগীর চিকিৎসায় বেসরকারি পর্যায়ে প্রথম একটি ফিল্ড হাসপাতাল প্রস্তুত করা হয়েছে। ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান নাভানা গ্রুপের সহায়তায় সীতাকুণ্ডের সলিমপুরে ফিল্ড হাসপাতালটি গড়ে তুলেছেন ডা. বিদ্যুৎ বড়ুয়া। প্রাথমিকভাবে ৪০টি শয্যা নিয়ে গতকাল থেকে এ হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা চালু হয়েছে। মাত্র ১৫ দিনের প্রচেষ্টায় হাসপাতালটি প্রস্তুত করে তুলেছেন এর উদ্যোক্তা ডা. বিদ্যুৎ। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এ উদ্যোগে সহায়তা করেছেন বলে জানিয়েছেন তিনি।
প্রসঙ্গত, ২০ এপ্রিল পর্যন্ত ৩৯ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন চট্টগ্রাম জেলায়। এর মধ্যে ২৪ জন মহানগরের। ১৫ জন উপজেলার বাসিন্দা। ৩৯ জনের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ৫ জনের। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত সন্দেহজনকসহ মোট ৪২ জন রোগী নির্ধারিত সরকারি দুটি হাসপাতালের আইসোলেশনে ভর্তি রয়েছেন বলে জানান সিভিল সার্জন।
Discussion about this post