শিক্ষার আলো রিপোর্ট
সুধী দর্শকমন্ডলী! এটি কোন জংলা বা ভাগাড় নয়, নয় কোন পরিত্যক্ত ভবনের ধ্বংসাবশেষ! এটি চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এবং তিন পার্বত্য জেলার শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও বি এড শিক্ষার্থীদের একমাত্র কলেজ ক্যাম্পাস। যার নাম সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ,চট্টগ্রাম। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত এই কলেজে শিক্ষক দের বিএড ট্রেনিং এর পাশাপশি বিএড অনার্সও মাস্টার্স কোর্স অধ্যয়ন করে শত শত শিক্ষার্থী।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি প্রায় ১০ বছর ধরে পরিত্যক্ত ক্লাসরুম, হোস্টেলরুম গুলো ক্রমে ময়লা আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। পরিণত হয়েছে কিউলেক্স ও এডিস মশাসহ নানা কীটের উত্তম আবাসস্থলে।এরই সাথে ঝুঁকিপূর্ণহয়ে উঠছে ভবনের অবকাঠমো!

এই প্রশাসনিক ভবনের নিচতলায় পরিত্যক্ত ক্লাসরুমগুলো, আর এর উপরেই চলছে ক্লাস। রয়েছে শিক্ষক মিলনায়তন ও অধ্যক্ষের অফিস।চলমান ক্লাসরুমের জানালার পাশের চিত্র দেখুন। পরিত্যক্ত ক্যান্টিন ভবন এবং আবর্জনাপুর্ণনোংরা জঙলা, মশার আরও একটি আড্ডাখানা। অন্যদিকে পরিত্যক্ত রুমগুলোর পাশেই রয়েছে একটি জামে মসজিদ, যেখানে কলেজসহ এলাকার মুসল্লীরাও নামাজ পড়েন।

এখানেই শেষ নয়। ছবিতে দেখছেন পুরানো হোস্টেল ভবন, যা পরিত্যক্ত হয়েছে ১০ বছর আগে। এর নীচতলার অবস্থা আরও ভয়াবহ! নিকষ কালো দূষিত পানি, কীট যেখানে কিলবিল করছে।
নতুন হোস্টেলের বিপরীতে বিজ্ঞান উন্নয়ন কেনদ্র হোস্টেল।এর নীচতলার চিত্র দেখুন।ধ্বংসপ্রাপ্ত আসবাবপত্র, আর ফ্লোরে জমে থাকা দূষিত পানি! এটি যেন একটি মশক উন্নয়ন কেন্দ্র ! এর উপরতলায় এখনও হোস্টেল বরাদ্দ দেয়া হয় প্রশিক্ষণার্থী দের। এই হোস্টেলের পাশেই একাডেমিক ভবন -২, যার নীচ তলারও একই অবস্থা ! এর ২য় ও ৩য় তলায় ক্লাস চলে।
আর নতুন হোস্টেলের পশের ভবনটি অধ্যক্ষের বাসভবন। এটিও পরিত্যক্ত ভুতুড়ে ভবন বলে পরিচিত।এর পশেই রয়েছে ছাত্রী হোস্টেল ।৩ তলা ছাত্রী হোস্টেলের নীচ তলাটি পরিত্যক্ত। দূষিত পানি ও আবর্জনায় ভরা।
এবার আসা যাক মাঠ প্রসংগে।জানা যায় ২০১৯ সালের নগরজুড়ে অতিবৃষ্টির কারণে প্লাবিত হয় এই কলেজ মাঠটি। পরে পরিচর্যার অভাবে ক্রমে চারপাশে সবুজ গাছ বেষ্টিত এই প্রাণচঞ্চল মাঠটির অপমৃত্যু ঘটে! পরিণত হয় ডোবাতে। অথচ ৫ বছর আগেও এ মাঠটিতে চলতো প্রশিক্ষণার্থী দের নিয়মিত পিটি প্যারেড ও খেলাধূলার আয়োজন। আশেপাশের শিশু কিশোরদের খেলার মাঠও ছিলো এটি, ছিলো বিকেলে বয়স্কদের হাঁটার জায়গা!
৬ মাস আগে নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মো. জহিরউদ্দিনের প্রচেষ্টায় সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে পার্শ্ববর্তী খাল খনন প্রকল্পের মাটিতে বিনাখরচে ভরাট করা হয় মাঠটি।কিন্তুযথাযথ সমন্বয়ের অভাবে অপরিকল্পিত ভরাটের ফলে মাঠটি টিলাতে পরিণত হয়! একই পরিণতি হয় প্রশাসনিক ভবনের সামনে শহিদ মিনার প্রাংগনটিরও !

খানাখন্দে ভরা এই টিলায় রয়েছে থেমে থেমে হওয়া বৃষ্টির পানি জমার নানা আধার!ফলে এডিস মশার উর্বর চাষাবাদ কেনেদ্রপরিণত হয়েছে এই মাঠ টি। শুধু বর্ষাকাল নয় অন্যান্য মৌসুমেে ও বৃষ্টি হলেই এই সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে।
এই প্রাণ ঘাতী পরিবেশ বিপর্যয়ে প্রচন্ড স্বাস্থ্য ঝুঁকির মাঝেই বছরের পর বছর চলছে শতশত শিক্ষার্থীর শিক্ষা কার্যক্রম। ঝুঁকিতে রয়েছেন শিক্ষক কর্মচারীরাও! সবচেয়ে বেশী ঝুঁকিতে আছেন হোস্টেল শিক্ষার্র্থী!
এদিকে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন অফিস সুত্রে জানা গেছে, এবছর ডেংগু ও চিকনগুনিয়া রোগের সর্বোচ্চ প্রকোপ ঘটেছে চট্টগ্রামে। দিন দিন বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা।ভয়ের বিষয়টি হলো বাকলিয়া এলাকা অন্যতম প্রধান এডিসপ্রবণ এলাকা বলে চিহ্নিত হয়েছে। উলেল্খ্য ডেংগু ও চিকনগুনিয়া উভয় রোগেরই বাহক এডিস মশা। আবার মশার এমন আবাসস্থল আশেপাশের আ্বাসিক এলাকার জন্যও বিপজ্জনক বলে জানান মেডিসিন বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডা. শাকিল ওয়ায়েজ।
সদ্য ভর্তি হওয়া একজন বিএড প্রশিক্ষণার্থী শিক্ষক বলেন তাঁর স্বপ্ন ভংগের বেদনার কথা, ওরিয়েন্টেশন ক্লাসে এসই হোঁচট খেয়েছি। কলেজ গেটে ঢুকতেই স্বাগত জানায় ডাস্টবিন, একাডেমিক ভবনের সামনে শহিদ মিনারের সামনে আবর্জনার স্তুপ, এ যে শহিদ মিনারকেই অবমাননা! স্বপ্ন ছিলো চট্টগ্রামের একমাত্র শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি হবে সাজানো একটি পরিপাটি ক্যাম্পাস । কিন্তুএটাই কি জতি গড়ার করিগরদের প্রশিক্ষণ পরিবেশ? আমরা দ্রæত এর প্রতিকার চাই !
বি এড অনার্স পড়ুয়া একজন হোস্টেল ছাত্র বলেন, এখানে ভর্তির পর থকে আজ পর্যন্ত মাঠে খেলতে পারিনি, এই মাঠ আগে ছিলো পনি ভরা ডোবা এখন হয়েছে জংগল । মশা আর সাপ খোপের আস্তানা! দিনের বেলাতেই মশারী টাংগিয়ে রাখতে হয়, দিনরাত মশার কয়েলের গন্ধে নি:শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।
এখানে ইনডোর বা আউটডোর কোন খেলার সুযোগ নেই। বিকেলে বিষন্ন মনে রুমেই বসে থাকি।চারিদিকে স্যাঁতস্যাতে ভাব, এ এক চরম অস্বাস্থ্যকর দম বন্ধ অবস্থা!

বিএড সমাপণী বর্ষের একজন প্রশিক্ষণার্থীর আক্ষেপ – গত এক বছরে আমাদের সকালের পিটি হয়নি, বার্ষিক ক্রিড়া প্রতিযোগিতায় মাঠের অভাবে সব ইভেন্ট করা সম্ভব হয়নি। কোনমতে করতে হয়েছে।
বিএড অনার্সএর একজন ছাত্র বলেন, এ বিষয়ে আমরা বারবার প্রিন্সিপ্যাল স্যারের কাছে আবেদন করেছি । তিনি আশ^াস দিয়েছেন, কিন্তু কোন কাজ হয়নি। পুরো ভবন সংস্কার হয়তো অনেক টাকার কাজ কিন্তু স্বল্প বাজেটে মাঠটাতো অন্তত সমান করে দেয়া যায়।স্যাররা আন্তরিক হলে এটি অবশ্যই সম্ভব বলে আমরা মনে করি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কলেজ শিক্ষক বলেন, চট্টগ্রামের অনন্য গর্বএই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এই পরিবেশ বিপর্যয় কোনমতে মেনে নেয়া যায়না।এটি আমাদের সকলের জন্য অত্যন্ত মানহানিকর।পরিত্যক্ত ভবনগুলো কোন সময় ধসে পড়লে বড় ধরণের দুর্ঘটনার আশংকাও রয়েছে । সাথে রয়েছে ডেংগু আতংক! তাই ছাত্রছাত্রীদের স্বার্থে অতি দ্রæত সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের জরুরি পদক্ষেপ কামনা করছি।
কলেজের এই পরিবেশ বিপর্যয়ের কথা স্বীকার করে অধ্যক্ষ মো. জহিরউদ্দিন বলেন, এগুলো দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত সমস্যা। আমি যোগদান করেছি মাত্র এক বছর আগে। ্আমি এসে ডোবায় পরিণত হওয়া মাঠটি ভরাটের উদ্যোগ নেই। নয়তো এতদিনে পরিস্থিতি আরও খারপ হতো।এখন খেলার মাঠ এবং শহিদ মিনার প্রাংগনটি দ্রæত সংস্কার করা জরুরি। আমি এবং আমার শিক্ষকবৃন্দ মিলে প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে আবেদন করেছি এবং উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে অবগত আছেন। এমনকি সম্প্রতি অন্তবর্তীকালিন সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের একজন নীতিনির্ধারক পর্যায়ের কর্মকর্তা সরেজমিনে পরিদর্শন করে গেছেন। তিনি নতুন ভবন নির্মাণেরও আশ্বাস প্রদান করেছেন। আশা করি তা অচিরেই অগ্রগতি পাবে।
চলমান সমস্যার সমাধান প্রসংগে তিনি বলেন, পরিত্যক্ত ভবনগুলো ভেংগে নতুন একাডেমিক ভবন ও হোস্টেল ভবন নির্মাণ এবং ক্যাম্পাসের নালাগুলো উঁচুকরে সংস্কার কর লেই কেবল এই সমস্যার দীর্ঘস্থায়ী সমাধান সম্ভব।
আপাতত মশা নিরোধে সিটি করপোরেশন কর্তৃক নিয়মিত ওষুধ স্প্রের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।
আর বর্ষামৌসুম শেষে মাঠ সংস্কারের একটি উদ্যোগের কথাও জানান প্রফেসর মো. জহিরউদ্দিন।
সবশেষে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন- বছরের পর বছর আবেদন করার পরও কেনো শিক্ষামন্ত্রণালয় এই কলেজ সংস্কারে কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছেনা? তাই তাদের দাবী চট্টগ্রাম জেলার শিক্ষাবিস্তারে প্রধান কান্ডারী এই টিচার্স ট্রেনিং কলেজটির প্রতি সকল প্রকার বৈষম্যমূলক দৃষ্টি পরিহার করে অতিদ্রæত সার্বিক উন্নয়নের পদক্ষেপ নেয়া হোক। বৈষম্য বিরোধী বর্তমান সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টার কাছে এই আবেদন জানিয়েছেন চট্টগ্রামের শিক্ষক ও ছাত্র সমাজ।
Discussion about this post