শিক্ষার আলো ডেস্ক
২০১৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগ থেকে এমবিএ পাস করেন আবু সালেহ মোহাম্মদ তারেক এলিন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে কিছু দিন চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘোরেন। কোথাও কোনো কাজের সুযোগ পাননি। উপায় না পেয়ে মনস্থির করেন পৈতৃক জমিতে কিছু একটা করবেন। সেই চিন্তা থেকে পরের বছর স্থানীয় কয়েকজন তরুণকে সঙ্গে নিয়ে পৈতৃক একটি পুকুরে মাছ চাষ শুরু করেন।
এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তারেক এলিনকে। সফলতা ধরা দেয় এখানেই। মাত্র সাত বছরের মাথায় একটি পুকুর থেকে এখন ১৪টি পুকুরে মাছ চাষ করছেন তিনি। করছেন রেনু পোনা উৎপাদন, সৃষ্টি করেছেন কর্মসংস্থান। এর জন্য স্বীকৃতিও পেয়েছেন জাতীয়ভাবে। গত ২৪ জুলাই জাতীয় মৎস্য সপ্তাহের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক দেশের শ্রেষ্ঠ মাছচাষি হিসেবে স্বর্ণপদক ও ৫০ হাজার টাকা পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
আবু সালেহ মোহাম্মদ তারেক এলিন বিরামপুর উপজেরার বিনাইল গ্রামের একেএম শাহাজাহান আলীর ছোট ছেলে। তিনি পৈতৃক তিন বিঘা একটি পুকুরে মাছ চাষ শুরু করেন ২০১৪ সালে। খামারের নাম দেন মায়ের নামে ‘তাজ এগ্রো ফার্ম’। মাত্র দুই বছরের মাথায় সফলতার মুখ দেখতে শুরু করেন।
তারেক এলিনের মৎস্য খামারে গিয়ে জানা যায়, ২০১৪ সালে দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলার বিনাইল গ্রামে তাজ এগ্রো ফার্ম প্রতিষ্ঠিত হয়। ওই বছর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর শেষে নিজ গ্রামে তাজ এগ্রো ফার্ম প্রতিষ্ঠা করেন তারেক এলিন। সফল উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য চাকরির পেছনে না ছুটে গুড একোয়া কালচার পদ্ধতিতে মাছ চাষ শুরু করেন। বর্তমানে ৬৮ বিঘা জমির ওপরে ১৪টি পুকুর নিয়ে গড়ে উঠেছে তাজ এগ্রো ফার্ম। এ ফার্মের পুকুরগুলোতে রেনু থেকে মাছের পোনা উৎপাদন করা হয়। পাশাপাশি চাষ হয় দেশীয় প্রজাতির কার্প জাতীয় রুই, কাতল , মিগেল, সিলভার ব্রিগেড, পাবদা, শিং, কই, মাগুর ও টেংরা মাছ।
আরও পড়ুনঃ ‘জেসিআই’ বাংলাদেশ অ্যাওয়ার্ড পেলেন ৩১ তরুণ উদ্যোক্তা
এছাড়াও স্বল্প পরিসরে গরুর খামার, ছাগলের খামার ও ফলের বাগান শুরু করেছেন। বর্তমানে খামারে গ্রামের নারী-পুরুষসহ কর্মসংস্থান হয়েছে ১২ জনের। তাজ এগ্রো ফার্ম নিজ জেলার পোনা ও মাছের চাহিদা মিটিয়ে পার্শ্ববর্তী রংপুর, গাইবান্ধা, নীলফামারী ও লালমনিরহাট জেলায়ও পোনা সরবরাহ করছে। প্রায় দুই শতাধিক খামারি নিয়মিত তাজ এগ্রো ফার্ম থেকে মাছের পোনা সংগ্রহ করেন। পোনা ও মাছের উৎপাদন অব্যাহত রেখে দেশের মানুষের আমিষের চাহিদা পূরণে তাজ এগ্রো ফার্ম কাজ করে যাচ্ছে। গত অর্থবছরে দিনাজপুরের পার্বতীপুর মৎস্য বীজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান থেকে জেলার সর্বোচ্চ রেনু সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে তাজ এগ্রো ফার্মকে মূল্যায়ন করা হয়েছে।
তাজ এগ্রো ফার্মের নারী শ্রমিক ফেন্সি আরা বলেন, আমিসহ এই খামারে চারজন নারী শ্রমিক কাজ করেন। আমাদের কাজ হচ্ছে মাছের খাদ্য তৈরি করা, পুকুরের পাখি তাড়ানো ও পুকুর পাড়ের আগাছা পরিষ্কার করা। বাসার কাজের পাশাপাশি এই খামারে কাজ করে আমাদের পরিবারের সচ্ছলতা এসেছে।
তাজ এগ্রো ফার্মের কর্মচারী আক্কাস আলী বলেন, আমি শুরু থেকে এই ফার্মে কাজ করছি। আমিসহ এখানে ১২ জন কাজ করেন। সঙ্গে আরও সাতটি জেলে পরিবার এখানে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে সংসার চালান। আমরা ভালো মানের মাছের পোনা উৎপাদন করি বলে আমাদের খামারের মালিক এলিন ভাইকে প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক দিয়েছেন। এতে আমরা অনেক খুশি। আমরা আমাদের পুকুরের সবচেয়ে বড় মাছটি প্রধানমন্ত্রীকে খাওয়াতে চাই।
দেশসেরা মাছচাষি আবু সালেহ মোহাম্মদ তারেক এলিন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করে বাড়িতে ফিরে চাকরির পেছনে না ছুটে মৎস্য অফিসে প্রশিক্ষণ নিই। পরে একটি পুকুরে গুড একোয়া কালচার পদ্ধতিতে পোনা উৎপাদন শুরু করি। প্রথম যখন মাছ চাষ শুরু করি এলাকার অনেকে বলতো- এত পড়াশোনা করে কী লাভ হলো। মানুষের কথায় কান না দিয়ে কাজে মনোযোগ দিয়ে একটি পুকুরে পোনা উৎপাদন শুরু করি। বর্তমানে নিজস্ব জমিতে ছোটবড় ৯টি পুকুর ও লিজ নেওয়া চারটি পুকুরে মাছ চাষ করছি।
২০২১-২২ অর্থবছরে চার হেক্টর জলায়তন বিশিষ্ট পুকুরে কার্প জাতীয় রুই মাছ, শিং, পাবদা, গুলশা ও টেংরা মাছের মোট ৪৬ লাখ পোনা উৎপাদন করেছি। মূল্যায়ন বছরে ৫৫.৩৮ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে বছরান্তে পেয়েছি ৮৭.০৭ লাখ টাকা। মাছ চাষের পাশাপাশি ছোট করে গরু-ছাগলের খামার ও ফলের বাগান শুরু করেছি। কৃষিতেও তাজ এগ্রো ফার্ম অবদান রাখতে চায়। ফার্মে এখন ১২ জন কর্মচারী কাজ করেন। তার মধ্যে চার নারী শ্রমিক আমার ফার্মে কাজ করেন। আমার মাছ চাষ করা দেখে এ অঞ্চলের বেকার ২০ জন যুবক মাছ চাষ করে এখন স্বাবলম্বী। তারা অন্যের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে। আমার এখানে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। কেউ মাছ চাষ করতে চাইলে আমি তাকে সব ধরনের সহায়তা করি।
বিরামপুর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা কাউসার হোসেন বলেন, আবু সালেহ মোহাম্মদ তারেক এলিন দেশের মধ্যে প্রথম কম বয়সী মৎস্য উদ্যোক্তা হিসেবে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক স্বর্ণপদক পেয়েছেন। তার ফার্মে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে রেণু থেকে পোনা উৎপাদন করা হয়। গুণগতমান উন্নত হওয়ায় তা মৎস্য খামারিদের কাছে বেশ গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।
তিনি আরও বলেন, হেক্টর প্রতি সাত লাখ পোনা উৎপাদন, খামারের আয় ব্যয়ের হিসাব, সরকারি রাজস্ব প্রদান, নারীদের কর্মসংস্থানসহ সবকটি শর্তপূরণ সাপেক্ষে এই সম্মাননা পেয়েছেন আবু সালেহ মোহাম্মদ তারেক এলিন। উপজেলা মৎস্য অফিস শুরু থেকেই তাকে বিভিন্নভাবে পরামর্শ ও সহযোগিতা করে যাচ্ছে। সৌজন্যে-ঢাকা পোস্ট
Discussion about this post