ড. মোহাম্মদ আল-মামুন
করোনা পরিস্থিতিতে ব্রয়লার মুরগি নিয়ে চলমান গুজব ও জনমনে বিভ্রান্তি দেখে প্রয়াত কবি শামসুর রাহমানের ‘পণ্ডশ্রম’ কবিতার দুটি চরণের কথা মনে পড়ে যায়- ‘এই নিয়েছে ঐ নিল যাঃ! কান নিয়েছে চিলে,/ চিলের পিছে মরছি ঘুরে আমরা সবাই মিলে’। একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রাণঘাতী মহামারি করোনাভাইরাসের সংক্রমণে বাংলাদেশসহ সারাবিশ্ব আক্রান্ত। সারা পৃথিবী এই মহামারির বিপক্ষে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। যেখানে প্রতিরোধের প্রধানতম উপায়গুলো হলো সামাজিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন, পারস্পরিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং প্রচুর প্রাণিজ আমিষ যেমন দুধ, ডিম, মাংস গ্রহণ করা। অথচ বাংলাদেশে অনেকে জনমনে আতঙ্ক তৈরি করে গুজব ছড়ায় যে, ব্রয়লার মুরগি খেলে করোনা আক্রান্তের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এমন গুজবে কেউ কেউ দুধ, ডিম, মাংস থেকে মুখ ফিরিয়েও নেয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সরাসরি এই গুজবটি নাকচ করেছে। এ ছাড়া ‘আফ্রিকা চেক’ তাদের ওয়েবসাইটে সরাসরি এই গুজবটিকে নাকচ করে দিয়ে ব্রয়লার মুরগির মাংস ভালোমতো রান্না করে খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এমন গুজব প্রকাশ পাওয়ায় দৈনিক টাইমস অব ইন্ডিয়া পত্রিকাতে ‘ব্রয়লার মুরগি খাওয়ায় করোনা সংক্রমণের কোনো ঝুঁকি নেই’ শিরোনামে খবর প্রকাশিত হয়। সারাবিশ্বে করোনায় সংক্রমিত ব্রয়লার মুরগির একটি প্রমাণও পাওয়া যায়নি। সাধারণ দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করলে বলা যায়, ব্রয়লার মুরগি যদি করোনার বাহক হতো, তবে সবার আগে খামারি ও ব্যবসায়ীরা আক্রান্ত হতো।
করোনা রোগটি মূলত কভিড-১৯ ভাইরাসের কারণে হয়, যা মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে পরাজিত করে ফুসফুসকে আক্রমণ করে। কার্যকর ওষুধ ও ভ্যাকসিন এখনও আবিস্কার না হওয়ায় রোগীর অনেক ক্ষেত্রে মৃত্যুও হয়। এমতাবস্থায় সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য প্রাণিজ আমিষ যেমন দুধ, ডিম, মাংস খাদ্য তালিকায় রাখার কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বের মানুষ করোনা নিয়ে আতঙ্কিত ও ভীতসন্ত্রস্ত। যে কোনো ধরনের আতঙ্ক বা ভয় মানুষের মস্তিস্কে প্রভাব ফেলে। যার কারণে মস্তিস্ক থেকে বিভিন্ন ক্ষতিকারক হরমোন যেমন এড্রেনালিন, করটিসল রক্তে নিঃসৃত হলে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যার জন্য করোনা সংক্রমণে মৃত্যুহার ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য আতঙ্কিত না হয়ে আপনার রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে করতে হবে আরও শক্তিশালী। প্রাণিজ আমিষ যেমন গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির মাংসে প্রচুর পরিমাণে লাইসিন, মিথিয়োনিনসহ বিভিন্ন বায়োঅ্যাকটিভ কম্পোনেন্ট পাওয়া যায়। সিসটেইন ও মিথিয়োনিন রূপান্তরিত হয় গ্লুটাথিয়নে, যা দেহে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। ডিমে প্রাপ্ত কলিন এবং ট্রিপ্টোফেন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা অবস্থাতেও মানবদেহের ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়ক। গবেষণায় আরও দেখা গেছে, গরুর দুধে প্রাপ্ত প্রোবায়োটিক, ভিটামিন ‘ডি’ এবং ইমুনোগ্লোবিন মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করে। করোনার কোনো কার্যকর চিকিৎসা নেই। সুতরাং ‘প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ ব্যবস্থাই উত্তম’।
ব্রয়লার মুরগির মাংসে প্রচুর পরিমাণ আয়রন, সেলেনিয়াম, জিঙ্ক, ফলিক অ্যাসিড, ভিটামিন বি১, বি৬, বি১২সহ ভিটামিন এ, ডি, ই, ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড পাওয়া যায়, যা মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করে। অনুসন্ধান বলছে, অদ্যাবধি করোনায় মৃতদের মধ্যে অধিকাংশ রোগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ছিল খুবই দুর্বল এবং তারা বিভিন্ন রোগ যেমন ঠান্ডা, ফুসফুসজনিত সমস্যা, হার্টের রোগ, উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসজনিত রোগে আক্রান্ত ছিল। সুতরাং করোনা যুদ্ধে জয়ী হতে হলে আমাদের ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর বিকল্প নেই, যা সম্ভব আমাদের বেশি বেশি প্রাণিজ আমিষ গ্রহণের মাধ্যমে। সুতরাং বেশি করে ডিম, দুধ ও ব্রয়লার খাই, করোনার ঝুঁকি কমাই।
অধ্যাপক, অ্যানিম্যাল নিউট্রিশন বিভাগ, বাকৃবি
Discussion about this post