অনলাইন ডেস্ক
অদম্য মনোবল, আপরিসীম ধৈর্য, নিরন্তর সচেতনতা এবং চিকিৎসার ওপর অবিচল আস্থা থাকলে করোনার মতো কঠিন ব্যাধিকে কিভাবে জয় করা যায় সেই অভিজ্ঞতাই বর্ণনা করলেন সদ্য করোনা জয় করা নির্ভীক তরুণী স্নিগ্ধা। হালিমা তুর্য স্নিগ্ধার বাড়ি কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলার কমলপুর গ্রামে।
গত ১৭ এপ্রিল হঠাৎ তার শরীরে করোনার অস্তিত্ব শনাক্ত হয়। ইতোমধ্যে তার শরীর থেকে ষাটোর্ধ্ব বয়সী বাবা কাজী আবুল হোসেন ও বোন নওশিন শার্মিলী নিরার মধ্যেও করোনা সংক্রমিত হয়। তাদের সবাইকে ভর্তি করা হয় জেলার করোনা চিকিৎসার হাসপাতাল ‘শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
স্নিগ্ধার ভাষ্য মতে, নিজে আক্রান্ত হলেও আমার মনোবল শক্ত ছিল। আমি প্রত্যয়ী ছিলাম যে, এই কঠিন ব্যাধিকে আমি জয় করতে পারবো। কিন্তু ভয় হচ্ছিল বৃদ্ধ বাবা ও ছোট বোনকে নিয়ে। কিন্তু অদম্য মনোবল ও সাহস দিয়ে তারাও করোনাকে জয় করেছে।
সৈয়দ নজরুল মেডিকেল কলেজ ও পরিবার সূত্রে জানা যায়, পরিবারের দুই মেয়ে ও তাদের বাবা করোনা জয় করেছেন। গত ১০ দিন আগে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন তারা। পরিবারের অভিভাবক কাজী আবুল হোসেন ব্যবসায়ী। তার দুই মেয়ে হালিমা তুর্য স্নিগ্ধা ও নওশিন শার্মিলী দু’জনই কলেজে পড়েন। পাশাপাশি স্নিগ্ধা ভৈরবের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের চেনা মুখ। ভৈরব শহরের বেশিরভাগ মানুষের কাছে পরিচিত স্নিগ্ধা। মাত্র ১০ দিন অবিরাম চিকিৎসা সেবা ও নিজেদের নানা কৌশল প্রয়োগ করে তারা করোনাকে জয় করেছেন।
জানা গেছে, গত ১৭ এপ্রিল স্নিগ্ধা করোনায় আক্রান্ত হলে পরিবারে সদস্যদের মাথায় বাজ পড়ে। কিভাবে, কেমন করে আক্রান্ত হলো করোনায়? স্থানীয় প্রশাসন তদন্ত শুরু করে। স্নিগ্ধা গত এক সপ্তাহের মধ্যে কোথায় কার কাছে গেছে? বেরিয়ে এলো প্রকৃত ঘটনা। তারই বন্ধু সাংস্কৃতিককর্মী আর্থ কিশোর নামের এক যুবকের ফার্মেসিতে গিয়েছিল ওষুধ ও মাস্ক কিনতে। আর্থ কিশোর তার দু’দিন আগে (১৫ এপ্রিল) করোনায় আক্রান্ত হয়ে ঢাকার কুর্মিটোলা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। স্নিগ্ধার আক্রান্তে খবরে পরিবারের সদস্যরা ভেঙে পড়েন। কিন্ত মনোবল ভাঙেনি স্নিগ্ধার। আক্রান্ত হওয়ার পর রাতেই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লুবনা ফারজানা তাকে কিশোরগঞ্জের সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য পাঠিয়ে দেন। পরদিন তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়। ১৯ এপ্রিল তার বাবা আবুল হোসেন ও ছোটবোন নিরার রিপোর্টও পজিটিভ আসে। স্নিগ্ধার সংস্পর্শেই তার বাবা বোন ও করোনায় আক্রান্ত হয়। তার বাবা ও ছোটবোনকেও একই হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য পাঠায় প্রশাসন। এ খবরে স্নিগ্ধার মনোবল ভেঙে পড়ে। নিজের জন্য নয়, তার বৃদ্ধ বাবা ও ও বোনের জন্য। কারণ তার ৬০ বছর বয়সী বাবার হৃদরোগসহ শরীরে আরও কিছু রোগ রয়েছে। বাবা-মেয়ে একই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকায় হারানো মনোবল ফিরে পেতে চেষ্টা করেন সবাই। হাসপাতালে থেকে নিয়মিত তারা ওষুধ খাওয়াসহ অন্য রোগীদের চেয়ে কঠোর সব নিয়ম মেনে চলতে থাকলেন। এরপর গত শুক্রবার আবারও বাবা-মেয়েদের নমুনা সংগ্রহ করে পাঠানো হয় পরীক্ষার জন্য। আনন্দের বিষয় সোমবার তিনজনেরই রিপোর্ট নেগেটিভ আসে।
মঙ্গলবার কথা হয় স্নিগ্ধার সঙ্গে। তার ভাষ্য, আক্রান্ত হওয়ার পর তিনি তার বাবাকে বলেছিলেন, তার জন্য কোনো চিন্তা না করতে। তিনি হাসপাতালে প্রাণঘাতি করোনার সঙ্গে যুদ্ধে করতে নেমেছেন। প্রয়োজনে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে যাবেন কিন্ত পরাজিত হবেন না । তবে ভেঙে পড়েছিলেন বাবার জন্য।
তিনি বলেন, বাবাও আমকে অনুসরণ করে নিয়ম মানায় সুস্থ হয়েছেন। এটাই আনন্দ। হাসপাতালে প্রতিদিন ৫ বার গরম পানিতে ভাপ নেয়াসহ গারগিল করা, লেবুর শরবত, আদা-লং লেবু দিয়ে দৈনিক ৮-১০ বার চা পান, ফলমূল খাওয়া সবই করেছি আমরা। চিকিৎসকদের দেওয়া ওষুধ নিয়মিত সেবন করেছি।
স্নিগ্ধা আরও জানান, ছোটবোন তার সঙ্গে মহিলা ওয়ার্ডে ছিল আর বাবা ছিলেন পুরুষ ওয়ার্ডে। তিনি নিজেই ফেসবুক ও মিডিয়া থেকে এসব নিয়ম-কানুন জেনে বাবা-বোনকে সবকিছু করিয়েছেন। চিকিৎসকরাও তাদের একই পরামর্শ দিয়েছেন। হাসপাতালে থাকা খাওয়ার কোনো সমস্যা না থাকলেও চিকিৎসক বা নার্সরা রোগীদের কাছে আসেন না। এজন্য তার ভয় ছিল। দিনে একবার ডাক্তার ওয়ার্ডে এসে চোখ বুলিয়ে চলে যান। নার্সরা ওষুধ ও খাবার দূরের একটি কেবিনে রেখে ফোনে বলে দিয়ে চলে যান। এই হলো চিকিৎসা। এভাবেই তারা তিনজন সুস্থ হয়েছেন। এখন অপেক্ষা করছেন বুধবার না হয় বৃহস্পতিবার তারা বাড়িতে মায়ের কাছে ফিরবেন। প্রতিদিন তাদের মা ফোন করে খবর নিচ্ছেন।
স্নিগ্ধা বলেন, মাকে বলেছি ২/৩ দিনের মধ্যেই তোমার কোলে ফিরে আসব।
কিশোরগঞ্জের সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. সৈয়দ মনজুরুল হক জানান, হাসপাতালে এ পর্যন্ত ২৬ জন রোগী করোনা চিকিৎসায় ভর্তি হয়েছেন। তারা সবাই ভালো আছেন। ভৈরবের রোগী আবুল হোসেন ও তার দুই মেয়ের রিপোর্ট নেগেটিভ আসলেও তাদেরকে আবার পরীক্ষা করা হবে। ওই পরীক্ষায় নেগেটিভ আসলে দুই/তিন দিনের মধ্যে তাদের হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হবে।
কিশোরগঞ্জের সিভিল সার্জন মো. মজিবুর রহমান জানান, বাবা-মেয়েরা ভালো আছে। তাদের সার্বিক পরিস্থিতি বলে দেয় তারা ভালো হয়ে গেছে। তারপরও নিয়ম অনুযায়ী দ্বিতীয় রিপোর্টে নেভেটিভ হলেই তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে। মঙ্গলবার রাতে অথবা বুধবার তাদের দ্বিতীয় পরীক্ষার রিপোর্ট আসবে।
Discussion about this post